Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে


খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

শৈশবে এই কবিতাটি আবৃত্তি করতাম। আমার মত অনেকেই করতো। শৈশবের সরল চিন্তায় ভাবতাম, বাবা আমার মনের মধ্যে থাকেন। বাবার কথা মনে হলে, তাঁর চেহারাটা মনের মধ্যে ভাসতো। ভাবতাম, তাহলে এটাই কবিতা’টির অর্থ। মাথা একটু গুলিয়ে যেতো, যখন মায়ের কথা মনে পড়লে, তাঁর স্নেহভরা চেহারাটা মনের আয়নায় ভেসে উঠতো। কবির ওপর একটু অভিমান হতো। কবি কেন লিখলেন না, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর মাতা, সব শিশুরই অন্তরে’। নিজের মনেই বুঝে নিতাম, কবি তো একজন বাবা। তাই বাবার কথাই লিখেছেন। মা হলে মায়ের কথা লিখতেন।
আজ পরিনত বয়সে শৈশবের খেয়ালি চিন্তা আর কবিতার সরল অর্থ গুলো মনে পড়লে হাসি পায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ কবি তো পিতার কথাই লিখবেন, যদিও মা তাঁর সবচেয়ে আপন। কবি মায়ের কোলেই বড় হয়েছেন। মনীষীরা মায়ের কথাই বেশী বলেছেন। নবী করিম (স:) বলেছেন, ‘সবচেয়ে আপন হলেন মা’, ‘মায়ের পদতলে স্বর্গ’; ‘মা-বাবাকে কখনো কষ্ট দিও না’। আমাদের অভিযোগ-অনুযোগ-আব্দার, সবতো মায়েরই কাছে। বাবাকে বলতে একটু ভয় ও হয়। তাই হয়তো মুখে বলি বাবার কথা, মা থেকে যান অন্তরে। জেন্ডার সচেতন এবং পুরুষতান্ত্রিকতা মুক্ত একজন কবি হয়তো শিরোনামের কবিতাটি এভাবে লিখতেন,
‘লুকিয়ে আছে শিশুর মাতা সকল শিশুর অন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে।’

বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি, শৈশবের সরল অর্থ সঠিক ছিল না। কবি বুঝাতে চেয়েছেন যে, আজকের ছোট্ট শিশুটিই বড় হয়ে একজন পিতা হবে। আগামীর পিতা সে অর্থে শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে আছে। শিশু বড় হলে পিতাটি জেগে উঠবে, অর্থাৎ উপযোগী বয়স হলে সে পিতা হবে। কবির এ কথাটি ও কি ঠিক ? মনে হয় না। শিশুটি যদি কন্যা-শিশু হয়। তাহলে বড় হলে সে মা হবে। আর ছেলে-শিশু হলে বড় হয়ে পিতা হবে। কবিতার পংক্তিটি আমি যেভাবে বর্ধিত করেছি, তাও টিকছে না।  আবার সংশোধন করছি ঃ

‘লুকিয়ে আছে শিশুর মাতা, কন্যা-শিশুর অন্তরে;
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, পুত্র শিশুর অন্তরে।’

কবি বেঁচে থাকলে, তাঁর এই অমর কবিতাটিকে শৈল্যবিদের মত ব্যবচ্ছেদ করার কারনে হয়তো ক্ষেপে যেতেন। কবিতার অঙনে বেরসিক অ-কবিদের পদচারনায় ক্ষিপ্ত হয়ে হয়তো আরেক অমর কবিতা লিখে ফেলতেন জেন্ডার বিভ্রাটের নিকুচি করে। যাক সেসব। আমরা ফিরে যাই শিশুদের মাঝে। সবার মত আমি ও এক সময় শিশু ছিলাম। বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-বোন, সহপাঠি-সবাইকে নিয়ে জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলো কাটিয়েছি তখন। এটা অবশ্য প্রবীন বয়সের উপলদ্ধি। ছাত্রাবস্থায় আমি কবিতা লিখতাম। তখনকার দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকায় ছোটদের পাতা ‘মুকুলের মহফিলে’ ছাপা হত। তারপর রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, কবি সুফিয়া কামাল, বিজ্ঞানী ড. আব্দুল্লাহ আল-মুতি প্রমুখের সংস্পর্শে এসে ১৯৫৭ সাল থেকে শিশু সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার শিশু-আহবায়ক হিসাবে কাজ করি। শিশু থেকে তরুন, তরুন থেকে অনেক বছর পেরিয়ে আজ প্রবীন হয়েছি কচি-কাঁচার মেলায় জড়িত থেকেই। ২০০১ সাল থেকে আমি শিশু প্রতিষ্ঠানটির কর্মকান্ডের পরিচালক এবং কেন্দ্রীয় সভাপতি। শিশুদের সংগে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে শিশু-শিক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ে কিছু কথা বলবো।

মা-বাবার হাত ধরে শিশুরা পৃথিবীর বুকে যখন পা রাখে, তখন তাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ধারনা থাকে না। তাদের নিওরন (Neuron) বা মস্তিস্ক কোষগুলো থাকে শূন্য। এই কোষগুলোই ধীরে ধীরে শ্রুতি, দর্শন ও স্পর্শ অনুভূতি গুলো মস্তিস্কে ধারন করে, ঠিক যেমন একটি অব্যবহৃত ভিডিও ক্যাসেট গান, কথা, দৃশ্য, ধারন করে। ক্যাসেটের মতই নিওরন কোষগুলো ধারনকৃত শব্দ, দৃশ্য, অনুভূতিগুলো উদগিরন করতে পারে এবং করে যাকে স্মরন প্রক্রিয়া বলি আমরা। এ ভাবেই জন্মের পর প্রথম চার-পাঁচ বছরের লদ্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির সমন্বয়ে শিশুর ‘মন’ গঠন হয়। মনের প্রকৃতি ও প্রকাশই তার ব্যক্তিত্ব। প্রত্যেক শিশুর দর্শন, শ্রবন, অনুভূতি তার নিজস্ব এবং অন্যের চেয়ে আলাদা। তাই প্রত্যেক মানুষের মানস ও ব্যক্তিত্ব স্বাতন্ত্রে উদ্ভাসিত।

জীবনচক্রে শিশু থেকে পূর্নবয়স্ক মানুষে রূপান্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও প্রবনতা অর্জন করতে হয় সবাইকে। মেধা ও বুদ্বিমত্তার বীজ জন্ম থেকেই ধারন করে একটি শিশু, প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়। ধীরে ধীরে সেই বীজকে প্রস্ফুটিত করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন চর্চ্চা ও সহায়ক পরিবেশ। কিন্তু প্রবনতা, পারস্পরিক সম্পর্ক, আবেগ, অনুকরন প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কেউই জন্মগ্রহণ করে না। প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় শৈশবের নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে। বাবা-মা, বাড়ীর অন্যন্য মানুষ, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আদেশ-নিষেধের ধরন, চাহিদা পূরণ-অপূরন, ¯েœহ-ভালবাসা প্রাপ্তির মাত্রা-এসবের ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয় ব্যক্তিত্ব। শিক্ষন প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিত্ব গঠন প্রক্রিয়া বেশ জটিল। মেধার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলেও আদর্শ ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপিত হয় শৈশবে, যা ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে থাকে। তাই কাঙ্খিত ও সংহত ভিত্তি প্রস্ততের জন্য প্রত্যেক শিশুর প্রয়োজন উপযোগী পরিবেশ এবং যথাযথ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। সমাজ উপযোগী স্বকীয় সত্বা গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেক শিশুকেই উপযোগী শিক্ষন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে লালন করা প্রয়োজন।

শিশুদের কিছু অধিকার রয়েছে, যা রক্ষা করার দয়িত্ব বড়দের তথা রাষ্ট্রের। অধিকার চর্চ্চা তথা সংরক্ষনের জন্য কিছু শিক্ষা অর্জন ও দায়িত্ব পালনের উপযোগী হতে হয় শিশুদের। এই প্রেক্ষিতে শিশু-অধিকার ও শিশু-শিক্ষা বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

১৯৮৯ সনের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদ শিশু অধিকার বিষয়ে একটি কনভেনশন বা সনদ গ্রহন করে। উক্ত সনদের সূচনায় বলা হয়, (১) শৈশবে শিশুদের প্রদান করতে হবে বিশেষ যতœ ও সহায়তা; (২) শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাবলিল উন্নয়নের জন্য তাকে পারিবারিক পরিবেশে লালন পালন করতে হবে এবং পরিবারে থাকতে হবে শান্তি, ভালবাসা ও পারস্পরিক সহযোগিতা; (৩) জন্মের পূর্বে এবং পরে শিশুর প্রয়োজন আইনানুগ ও বিশেষ নিরাপত্তা এবং যতœ; (৪) বিশে^র অনেক দেশে অনেক শিশু খুবই কঠিন অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন।

উপরোক্ত সূচনা বক্তব্যের পর বলা হয় ১৮ বছরের নীচে সকল মানুষই শিশু হিসাবে বিবেচিত হবে। অতঃপর জাতিসংঘের উক্ত সনদে শিশুদের জন্য ৫৪টি অধিকার সংবলিত আর্টিকেল যোগ করা হয়েছে। শিশু অধিকার  কনভেনশনে বাংলাদেশ ও স্বাক্ষর করেছে। শিশুদের কয়েকটি অধিকার সনদ এখানে উল্লেখ করা হলোঃ (১) প্রত্যেক শিশুর জীবন ধারনের মৌলিক অধিকার রয়েছে। তাদের জীবন যাপন ও উন্নয়নের অধিকার পূরণের জন্য রাষ্ট্রের সরকার সর্বাধিক সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহন করবে; (২) প্রত্যেক শিশুর জন্ম নিবন্ধন করতে হবে এবং নামকরন ও জাতীয়তা প্রাপ্তির জন্মগত অধিকার থাকবে; পিতা-মাতার পরিচিতি জানা ও যতœপ্রাপ্তির অধিকার শিশুর থাকবে; (৩) পিতা-মাতা, আইনানুগ অভিভাবক এবং পরিবার সদস্যদের পদমর্যদা, কার্যকলাপ ও বিশ^াস যাই থাকুক না কেন, শিশুদের সবধরনের বিভেদ থেকে রক্ষা করতে হবে; (৪) প্রত্যেক শিশু তার নাম, জাতিয়তা ও পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখার অধিকার ভোগ করবে; (৫) রাষ্ট্র ও সমাজ প্রত্যেক শিশুর ভিন্ন দেশে বেআইনী পাচার ও দেশে প্রত্যাবর্তনে বাধা দুরীকরনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করবে; (৬) প্রত্যেক শিশুর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ধারন ও প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে এবং শিশুর বয়স বিচারে সে সব চিন্তা-চেতনা ও প্রকাশকে গুরুত্ব দিতে হবে; (৭) প্রত্যেক শিশুর চিন্তার স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেক, ধর্মগ্রহন ও পালনের স্বাধীনতা থাকবে।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়য়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে শিশু অধিকার আইন, ২০১৩ সংসদে গৃহীত হয়েছে। এই আইনে নয় বছরের কম বয়সের শিশুকে গ্রেফতার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া বড়দের জেলে শিশুদের না রাখার বিধান রয়েছে। গবেষনায় জানা গেছে যে পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের মৃত্যুর হার গত দুই দশকে ৬০% হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে এই হার প্রতি হাজারে ৫৩ জন। বাংলাদেশ সরকার শিশুমৃত্যুর এই হার ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতি হাজারে বিশে নামিয়ে আনতে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারন করেছে।

শিশু অধিকারের পর শিশু শিক্ষা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশে শিশু শিক্ষা অবৈতনিক এবং সার্বজনিন। শিক্ষার জন্য বছরের প্রথম দিন সকল ছাত্রদের বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ৯০% এর অধিক শিক্ষার্থী ভর্তী হয়। তবে ঝড়ে পড়ার সংখ্যা নিয়ন্ত্রন করা প্রয়োজন।

শিশুদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে, স্বাস্থ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং সামাজিক দক্ষতা অর্জনে স্কুলের একাডেমিক শিক্ষার সাথে সাথে কো-কারিকুলার শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। এ পর্যায়ের শিক্ষা- প্রশিক্ষনের মধ্যে রয়েছে (১) খেলাধুলা (২) সাংস্কৃতিক কর্মকা- অর্থাৎ সুরচর্চ্চা, নৃত্য-চর্চ্চা, ছবি-আঁকা, শিশু-নাটক, আবৃত্তি, বক্তৃতা-উপস্থাপনা, বিতর্ক ইত্যাদি; এবং (৩) সামাজিক কর্মকা- যথা পথশিশুদের সাহায্য করা, দরিদ্রদের সহায়তা দান, শিশু সমাবেশ, শিশু পার্লামেন্ট, নিরক্ষর শিশুদের পাঠদান, ফাষ্ট এইড, বাগান করা, গাছ লাগান, শিশু অধিকার আদায়ের জন্য সচেনতা সৃষ্টি প্রভৃতি। দেশের সাধারন স্কুল সমুহে কো-কারিকুলার শিক্ষার ব্যবস্থা প্রায় নাই বল্লেই চলে। তবে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিষ্ঠান কচি-কাঁচার মেলা সহ স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ন স্ব-উদ্যোগে সারাদেশে শিশুদের কো-কারিকুলার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গুলোর কার্যক্রম প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তদুপরি সন্তানদের প্রাইভেট কোচিং এবং ‘এ-প্লাস’ পাওয়ার ব্যাপারে পিতা-মাতার উম্মাদনায় শিশুরা কো-কারিকুলার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খেলাধুলার অভবে শারিরিক গঠনে ঘাটতি থাকছে। অন্যদিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষার অভাবে মানস-গঠন ভীষনভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তদুপরি আধুনিক স্মার্ট ফোন শিশুদের মারাত্মকভাবে নেশায় ডুবিয়ে আত্ম-কেন্দ্রীক করে তুলছে। সব মিলিয়ে বিরাট সংখ্যক শিশু অসামাজিক রোবট হয়ে গড়ে উঠছে। এ অবস্থায় শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে কো-কারিকুলার শিক্ষাকে অন্তর্ভূক্ত করা সময়ের দাবী। আগামী প্রজন্মের শারিরীক-মানসিক গঠন ও বিকাশের জন্য এটি অপরিহার্য। 

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে