-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
সাম্প্রতিক কালে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক সহ বেশ কয়েকটি ঘটনা জনমনে উৎকষ্ঠা সৃষ্টি করেছে। শাহজালাল ব্যাংকের একজন পরিচলাক দুর্নীতির মামলায় জেলহাজতে রয়েছেন। চট্টগ্রামের থাতুনগঞ্জ সম্বন্ধে উৎকণ্ঠা জাগানো অনেক ঘটনা অনুচ্চস্বরে আলোচিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় আটকে পড়া টাকার অংক কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অনুদ্ঘাটিত আটকে পড়া ঋণ এবং জালিয়াতি-আত্মসাতের ঘটনা এবং ঘটনার সাথে জড়িত টাকার পরিমান আশঙ্কাজনক হবে বলে অনেকের ধারনা। ব্যাংকে জনগনের অর্থ জমা থাকে। তাই আমানতের খেয়ানত সীমা ছড়িয়ে গেলে উদ্বেগ জন্ম নেয়।
সরকারী ব্যাংকের জালিয়াতি এবং বেসরকারী ব্যাংকের দুর্নীতির আকার-প্রকার ভিন্ন। ঘটক অনুঘটক ও ভিন্ন। সরকারী ব্যাংকের মালিক সরকার। সরকারের শক্তিধর ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইঙ্গিত, আনুকুল্য ও সহায়তায় সরকারি ব্যাংকে দুর্নীতি-জালিয়াতি ঘটে থাকে। সেই সাথে ব্যাংক পরিচালনার জন্য সঠিক ব্যাক্তিদের নিয়োগদানে সরকারের স^ক্ষমতা প্রশ্নের সম্মুখীন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক বেসিক ব্যাংকের বোর্ড পূর্ণগঠনের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পাওয়ার পর সরকার একমাসের মধ্যেও কোন ব্যবস্থা নিয়ে চেয়ারম্যানকে ‘সসম্মানে’ পদত্যাগের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতার নজির রেখেছে। ইতিপূর্বে হলমার্কের ঘটনার পর মাননীয় অর্থমন্ত্রী হাল্কাভাবে বলেছিলেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা এমন বেশী কিছু না, ব্যাংকে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে’। এভাবে সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। শুধু বর্তমান সরকারই নয়, আগের সরকারও হাওয়া ভবন থেকে দুর্নীতি পরিচালনা করেছিল। ডান্ডি ডাইং সহ অনেক ঋন কেলেঙ্কারী তখন ঘটেছিল।
ব্যাংকের দুর্নীতির সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে। আশির দশকে ব্যাংকে দুর্নীতর ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। জেনারেল এরশাদ দুর্নীতিকে বাধামুক্ত করার জন্য সবচেয়ে সৎ ব্যাংকারদের সামরিক আইনে জেলে পুরেছিলেন। সেইসব স্বনামধন্য ব্যাংকাররা হলেন লুৎফর রহমান সরকার, মুশফেকুস সালেহীন, সৈয়দ আলী কবির প্রমুখ। সৎ ও দক্ষ ব্যাংকারদের শাস্তিদিয়ে এরশাদ দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সরকারগুলো ব্যাংকে হানা দিয়ে অর্থ লোপাটের অপসংস্কৃতি চর্চা করেছে। দুর্ভাগ্য, বর্তমান সরকার ও সরকারী ব্যাংকে অর্থ অপচয়ের ধারায় পানি সিঞ্চন করছে। এ থেকে উত্তরনের জন্য একটি সুপারিশ রাখতে চাই। সরকারী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, বোর্ড-সদস্য এবং ব্যবস্থপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের সার্চ-কমিটি গঠন করবেন। এ কমিটির সদস্য হবেন এমন ব্যাক্তিবর্গ যারা নিস্কলুষ জীবনের অধিকারী। শুধু সৎই নন, জনগন তাদের সৎ মনে করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গর্ভণর বৃন্দ, সুনামের অধিকারী-অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকারবৃন্দ, প্রাক্তন অর্থসচিববৃন্দ. বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হতে পারেন এই কমিটির সদস্য। সার্চ কমিটি একটি পদের জন্য দুজনের নাম সুপারিশ করবে। সরকার একজনকে নিয়োগ দেবে। উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচনে সরকারের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে এই প্রক্রিয়া সহায়ক হতে পারে। সেই সংগে আইনী প্রক্রিয়ায় কিছু সংশোধন আনা প্রয়োজন। বর্তমানে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাংক পরিদশর্নের ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় রিপোর্ট পেয়ে থাকেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকারী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং পরিচালককে অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র প্রাইভেট ব্যাংকের চেয়ারম্যান/পরিচালক অপসারনের ক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। একই দেশে সরকারী ও প্রাইভেট ব্যাংকের জন্য দু’ধরণের আইন থাকা অনুচিৎ। ব্যাংক কোম্পানী আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংশোধন করে প্রাইভেট ও সরকারী ব্যাংককে সমপর্যায়ে আনতে হবে। সরকারী ব্যাংকে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠায় এ ব্যবস্থা ফলপ্রসু হবে।
প্রাইভেট ব্যাংকের বিষয়টি একটু ভিন্ন। প্রাইভেট ব্যাংক পরিচালনয় সুশাসন প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের হলেও, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইভেট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সহ পুরো পর্ষদ অপসারণ করতে পারে, প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে এবং অন্যান্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, সে কারনে প্রাইভেট ব্যাংকের বিপর্য্যয়ের দায় দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর বর্তায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যংক সুপারভিশন বিভাগের কর্মকর্তাদের সততা এবং দক্ষতার এতটুকু ঘাটতি হলেই বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সম্ভবত: তেমনটাই ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন বিভাগের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিভাগের পরিদর্শক থেকে ডেপুটি গর্ভণর পর্যন্ত প্রতিটি কর্মকর্তাকে সন্দেহাতিতভাবে সৎ হতে হবে, সাহসী হতে হবে, দক্ষ হতে হবে। অনবরত রদবদলের মাধ্যমে এই বিভাগটিকে বির্তকের উর্ধে রাখা এবং সততা ও দক্ষতার মান বজায় রাখার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত গর্ভণরের উপর বর্তায়।
বিষয়গুলো জনগুৃরুত্বপূর্ণ। ‘ইগো’ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে সুশাসনের চেয়ে জনগনের আমানতের ট্রাস্টি হিসেবে বিবেচিত ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
0 Comments