-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলার বিচার শুরু হয়েছে। সদ্য গঠিত ট্রাইবুনাল ৩১ আগস্টের মধ্যে তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। শেয়ার নিয়ে গুজব ছড়ানোর দায়ে ব্রোকারেজ হাউজ কর্মকর্তা মাহবুব সারওয়ারকে দু’বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় মামলায় বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার নিয়ে গুজব রটনা ও কারসাজির দায়ে উক্ত কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস.এম. নুরুল ইসলাম এবং ইন্ডাষ্ট্রি পত্রিকার সম্পাদক এনায়েত করিমকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে তিন বছর কারাদন্ড ও দশ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তৃতীয় মামলাটি ছিল চিকটেক্সের শেয়ার কারসাজি নিয়ে। ১৯৯৬ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী সম্পর্কীত মামলাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এ মামলায় আসামীরা পালাতক। তাদের পক্ষে উকিল ছিলেন না। বিচারে অভিযুক্ত চিকটেক্সের দুই পরিচালক মাসুকুর রসুল ও ইফতেখার মোহাম্মদের সাজা হয়েছে, প্রত্যেকের চারবছর করে জেল এবং ৩০ লক্ষ টাকা করে জরিমানা। অনাদায়ে আরো ছ’মাস জেল।
জুন মাসে কাজ শুরুর পর মাত্র দু’মাসের মধ্যে তিনটি মামলার রায় দিয়ে ট্রাইবুনাল প্রসংশিত হয়েছেন। ট্রাইবুনাল দ্রুততার সাথে কাজ করেছেন। ‘জাষ্টিস ডিলেড, জাষ্টিস ডিনায়েড’। বিচার বিলম্বিত করাটাই অবিচার। ট্রাইবুনাল এ ব্যপারে দায়মুক্ত। কিন্তু আসলেই কি বিচার দ্রুত হয়েছে? মামলাগুলো ১৯৯৬ সালের। অর্থাৎ দীর্ঘ আঠারো বছর পর রায় হয়েছে। কাজেই সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নের সম্মুখীন। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এই ট্রাইবুনাল ১৯৯৬ সালে গঠন করা হলো না কেন? ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অনেক শক্তিমান (অপশক্তিমান?) লোকজন জড়িত ছিলেন, যার কিছু অভিযোগ ও বিবরণ রেকর্ডভূক্ত রয়েছে। ছিয়ানব্বই লুটতরাজের তদন্ত করেছিলেন জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অর্থনীতিবিদ আমীরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটি। তাদের রিপোর্টে শক্তিমানদের নাম এসেছিল। রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়নি। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল, যাতে শক্তিমানদের ‘মানহানি’ না হয়, শাস্তি তো দূরের কথা। একই কারনে তখন ট্রাইবুনাল গঠন করা হয় নাই বলে অনেকের ধারনা। জনস্বার্থের চাইতে শক্তিমানদের স্বার্থ অনেক বড়। আঠার বছর পর অনেক স্বাক্ষী অপসৃত। অনেক রেকর্ড নষ্ট হয়েছে। মানুষের স্মৃতিও ম্লান হয়েছে।
গত সপ্তাহের সংবাদপত্রের রিপোর্টে বাদী পক্ষের উকিল এবং ট্রাইবুনালের বিচারকের কিছু মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। বাদী সরকারের উকিল এক প্রশ্নের জবাবে নাকি বলেছেন যে তিনি কোর্টে আলোচিত মামলাটি সম্বন্ধে কিছু জানেন না। ‘তাহলে কেন মামলা লড়ছেন’- এ প্রশ্নের জবাবে উকিল নাকি বলেছেন ‘সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে’। তখন বিচারক নাকি এই দৈন্যদশায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন এবং অবস্থার উন্নতি না হলে কঠিন সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন। বিচারক তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সরকারী উকিলের বিষয়টি বিশ্লেষন করার দাবী রাখে। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন কি শক্তিমান রাঘববোয়ালদের রক্ষা করার জন্যই বিজ্ঞের স্থলে অজ্ঞ উকিল রেখেছে? নাকি উকিল ইচ্ছে করেই অজ্ঞ সাজার অনুশীলন করছেন, যাতে রাঘব-বোয়ালদের মামলা শুরু হলেই পুরোদ¯ুÍর অভিনয় করতে পারেন। ১৮ বছর পার করার পর ও যদি এস-ই-সি এত ‘সতর্কতা’ অবলম্বন করে, তাহলে সুবিচার প্রত্যাশা করা উচিৎ হবে কি?
অন্য দেশের দিকে একটু তাকানো যাক। চীনের শেয়ার বাজার অপেক্ষাকৃত নতুন হলে ও অনেক বড়। মাত্র দু’সপ্তাহ যাবৎ অস্থির হয়ে উঠেছিল। ধ্বস নামেনি। দরপতন ঘটেছিল। গুজব রটানো হয়েছিল যে, দরপতনের কারনে একব্যক্তি লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন এবং একটি বিস্ফোরনে তেরশত লোক নিহত হয়েছেন। চীনে কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তদন্ত সংঘটিত হয়েছে এবং একসপ্তাহের মধ্যে বিচারকার্য্য সমাপ্ত হয়েছে। ১৯৭ জনকে শাস্তি প্রদান করা হয়। ত্বরিৎ বিচারের ফলে চীনের পুজিবাজার সাম্ভব্য ধ্বসের কবল থেকে আপাতত বেচে গেলো।
চীন আর বাংলাদেশের তুলনা চিত্র তাহলে কেমন দাঁডালো? চীনে গুজব রটনার সপ্তাহকালের মধ্যে তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন করে ১৯৭ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে পুজিবাজারে বিরাট ধ্বস নামিয়ে হাজার হাজার মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করার ১৮ বছর পর মাত্র বিচার শুরু হয়েছে এবং একটি মামলায় সরকারি উকিল মামলার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে কিছু জানেনা না মর্মে কোর্টে বলেছেন। উকিল নিয়োগকারী সরকারী কর্তৃপক্ষ দায় এড়াবেন কিভাবে? বিচারের দায়িত্ব বিচারকের একার নয়। বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের বিজ্ঞ আইনজ্ঞের দায়-দায়িত্ব অনেক। সুবিচারে তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
আঠারো বছর পর বিচারের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। একেবারে না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে বিচার হওয়াও ভালো। রিপোর্টে প্রকাশ, ১৯৯৬ সালের ১০/১২টি মামলার বিচারের উপর নাকি উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বিদ্যমান। ট্রাইবুনাল স্থাপিত হওয়ার প্রেক্ষিতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হবে কি না, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। এস-ই-সি-কে উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার জন্য জোরালো আইনী প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে।
রাঘব-বোয়ালদের বিচারের বিষয়ে মুখ বন্ধ রেখেও পুজিবাজারের কিছু ভালো কথা বলা যায়। ১৯৯৬ সালের ধ্বসের পর কোন ব্যবস্থাই নেযা হয়নি বলে ২০০৯-১০ সালে আরো বড় ধ্বস সংঘটিত হয়েছিল। ২০১০ সালের দায়ী ব্যক্তিদের বিচার না হলে ও কিছু সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা ২০১০ সালের তদন্ত কমিটি কর্তৃক সুপারিশ করা হয়েছিল।
ঢাকা ও চট্রগ্রাম ষ্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচালাইজেশন সম্পন্ন হয়েছে। ডিমিউচিলাইজেশন অর্থ হলো ষ্টক ব্রোকারদের থেকে পরিচালনা বোর্ডকে পৃথক করা, যাতে স্বার্থের সংঘাত না ঘটে। এটি আদর্শকিভাবে হয়নি, ব্রোকারদের সেফটি ক্লজ রেখে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পরিচালনা বোর্ডে ব্রোকারদের সংখ্যালঘিষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি রয়েছে। শক্তিশালী সংখ্যালঘিষ্ঠরা দুর্বল সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। তাছাড়া প্রথম পাচঁ বছর ষ্টক এক্সচেঞ্জে নতুন কোন সদস্য না নেয়ার বিধানও রাখা হয়েছে।
সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী একটি ফলপ্রসু সার্ভেলেন্স কার্যক্রম গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়া ভোতিক একাউন্ট নামে পরিচিত ‘অমনিবাস’ একাউন্ট অনেক গড়িমসির পর শেষ পর্যন্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়নের ফলে, ২০১০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত শেয়ার মূল্য আকাশেও ওঠেনি এবং ধ্বসও নামেনি। এটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। তবে শেয়ার বাজারে ভালো শেয়ার আসছে না। গনআস্থা এখনো অর্জিত হয়নি। সংস্কারকৃত ষ্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদকে শুধু দক্ষ পেশাদার হলেই চলবে না, সেই সাথে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও নিরপেক্ষতা সাধারন্যে প্রদর্শন করতে হবে। তাহলে গণ-আস্থা ধীরে ধীরে ফিরে আসবে এবং হৃষ্টপুষ্ট ষ্টক এক্সচেঞ্জ গড়ে উঠবে। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় রাঘব-বোয়ালদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করে, দুর্বলদের কিছু শাস্তি দিয়ে, শুধুমাত্র সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে গণ-আস্থা ফিরে পাওয়া কঠিন হবে।
0 Comments