-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
বিগত শতাব্দির নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন কয়েকজন বিদগ্ধ ব্যক্তি। পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বৈচিত্রময় জীবনের অধিকারী জনাব আসফ-উদ্দৌলা। তিনি একাধারে সিভিল সার্ভিসের একজন প্রশাসক, জুডিশিয়াল সার্ভিসের একজন বিচারক, একজন প্রখ্যাত গায়ক এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। পর্ষদে পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও লেখক ড. আতিউর রহমান যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়েজিত হয়েছিলেন। আরো ছিলেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও নারী উন্নয়নের প্রগতিশীল নেত্রী খুশী কবির। স্মৃতি মন্থণ করে দু’ একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করবো ছোট্ট পরিসরে।
একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন নারায়নগঞ্জের একজন ব্যবসায়ী, যাঁর দেড় শতাধিক কোটি টাকা শ্রেনীবিন্যাসিত ঋণ ছিল সোনালী ব্যাংকে। তিনি কোন ভাউনপেমেন্ট না দিয়েই দীর্ঘ ত্রিশ বছরের জন্য ঋণটি রিশিডিউল করার জন্য এবং সুদের পূর্ন অংক মওকুফ করার জন্য কঠিন তদ্বির করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এধরনের অবাস্তব এবং অনৈতিক কাজে পরিচালনা পর্ষদ কোনভাবেই সম্মত হচ্ছিলেন না। এমন সময় একদিন সন্ধ্যায় আমি একটি অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে ঘরে ফিরে দেখি, ড্রয়িং রুমে বড় একটি সুদৃশ্য প্যাকেট। বাসায় একজন গৃহভৃত্য ছাড়া আর কেউ ছিল না। ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, প্যাকেটটি কোথা থেকে এলো। সে একটি ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে তুলে দিয়ে বল্ল, “একজন বড় সাহেব দিয়ে গেছেন”। ভিজিটিং কার্ডে ঐ ঋণ-খেলাপীর নাম লেখা। প্যাকেটে ছিল আমেরিকা থেকে ক্রয় করা স্যুট, শার্ট, টাই এবং ভারত থেকে আনা দামী শাড়ী। পরের দিন সকালে আমার একান্ত সহকারীর মাধ্যমে প্যাকেটটি খেলাপী ব্যক্তিটির অফিসে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলাম। প্যাকেটটি ফেরৎ পেয়ে লোকটি ফোন করে আমাকে বল্লেন, “স্যার, আমাকে এমনভাবে থাপ্পড় মারলেন ? আমি তো উপহার দিয়েছিলাম।” মেজাজটা খারাপ ছিল। শক্তভাবে বল্লাম, “ দামী উপহার গ্রহণ ব্যাংকের সার্ভিস রুলে নিষিদ্ধ। ভবিষ্যতে আর কখনো এমন কাজ করবেন না।”
ঘটনাটি ড. আতিউর রহমানকে বলতেই তিনি লাফিয়ে উঠলেন, “ আরে ঐ লোকটি তো আমার বাসায় ও উপটোকন নিয়ে এসেছিল। আমি তাকে ঘরে ঢুকতে দেইনি। বলেছিলাম, “আমার বাসায় সাহায্য করার লোক নেই। আপনি নিজেই প্যাকেটটি মাথায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যান।” অগত্যা আগন্তুক প্যাকেটটি কোলে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলেন।
ঐ খেলাপী ঋণগ্রহীতা মৃত্যু বরন করেছেন বিধায় তাঁর নামটি প্রকাশ করলাম না। এবার আরেকটি বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শোনাই। এ ঘটনাটি ও নারায়নগঞ্জের। বিদেশ সফরের পর মাত্র দেশে ফিরেছি। অফিসে যেতেই একজন সহকর্মী বিচলিতভাবে আমার কক্ষে প্রবেশ করে কিছু বলতে চাইলো। আমি শুনলাম। সারমর্ম এরকমঃ নারায়াগঞ্জের অমুক ঋণগ্রহীতার গুদামে শত শত ড্রামের আমদানিকৃত তেলের বিপরিতে সোনালী ব্যাংকে অনেক কোটি টাকা ঋণস্থিতি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ড্রামগুলোতে তেল নেই। ড্রামগুলো পানিতে ভর্তী। আমি সাথে সাথে নিরীক্ষক দল পাঠালাম। তারা এসে রিপোর্ট দিল “কিছু ড্রামে কিছু পানি প্রবেশ করেছে।” অগত্যা ড্রাম থেকে তেলের নমুনা সংগ্রহ করে BSTI তে পরীক্ষা করতে পাঠালাম। রিপোর্ট এলো, “তেলে কিছু পানি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।” স্যম্পল বা নমুনায় শতকরা কতভাগ তেল আর কতভাগ পানি আছে জানতে চেয়ে পুনরায়
BSTI কে চিঠি দেয়া হল। এবার রিপোর্টে যা লেখা হল তার অর্থ দাঁড়ায় ‘পানির উপরিভাগে কিছু তেল ভাসছে।” তারপর পুলিশের সহায়তায় গুদামে ঢুকে দেখা গেল ড্রামগুলো আদতে পানিতে ভর্তি। পানির উপরিভাগে সামান্য তেল ভাসছে। ব্যাংক থেকে মামলা করা হলো। প্রতারণায় দায়ে ফৌজদারী মামলা। ওয়ারেন্ট ইস্যু হল প্রতারককে গ্রেফতারের জন্য। প্রতারক সদম্ভে ঢাকা-নারায়নগঞ্জ সহ সর্বত্রই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশের রিপোর্ট ছিল, ‘তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
প্রায় দেড়যুগ পর এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা স্মরণ করছি আর ভাবছি, ঋণ-খেলাপী আর প্রতারকেরা এতকাল পরে কি এতটুকু দুর্বল হয়েছে? নাকি আরো শক্তিশালী হয়েছে?
0 Comments