Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণে নৈতিক শিক্ষা

    
                            খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ কৌতুকপ্রিয় মানুষ। বক্তৃতায় রসিকতা করেন, শ্রোতাদের আনন্দদান করেন, নিজেও বুঝি তৃপ্তিলাভ করেন। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই তিনি একাদিক্রমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। একবারও পরাজিত হন নাই। জনপ্রিয় এই মানুষটি সহজ-সরল জীবনযাপনকারী একজন ভালো মানুষের প্রতিচ্ছবি। সংসদ সদস্য হিসাবে প্রচুর কথা বলতে পারতেন। স্পীকার হবার পর প্রকৃতপক্ষে তাকে ‘লিসেনার’ বা শ্রোতা হতে হয়েছে। স্পীকারের শাব্দিক অর্থ বক্তা। কিন্তু সংসদের স্পিকার কথা কমই বলেন, শোনেন সর্বক্ষণ। স্পীকার থেকে হলে গেলেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর ভাষায় রাষ্ট্রপতির কথা বলার সুযোগ খুব কম। এ বিষয়ে তাঁর কৌতূকপূর্ণ বক্তৃতার সাদামাটা অর্থ দাঁড়ায়ঃ

“কাঁদতে মানা হাসতে মানা,
কথাটিও কইতে মানা।”

তবে বছরের শেষপ্রান্তে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। চ্যান্সেলার হিসাবে রাষ্ট্রপতির সমাবর্তনে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং এই উপলক্ষে তিনি কিছু কথা বলার সুযোগ পান। এই সুযোগটি উপভোগ করতে গিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ আঞ্চলিক ভাষায় (মাটির টানে?) কৌতূকে মোড়া যে সব মূল্যবান ও সাহসী বক্তব্য তিনি রেখেছেন, তা একদিকে যেমন সত্যকথনকে উৎসাহিত করেছে, তেমনি নৈতিক-সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে।
সম্প্রতি তিনি এক সমাবর্তন বক্তৃতায় বলেছেন যে, পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের একতা আছে। দুর্নীতিবাজদের একতা আছে, চোরাকারবারি-মুনাফাখোরদের একতা আছে। একতা নাই শুধু জনগণের মধ্যে।’ এমন সত্য কথা রাজনীতিকদের বলার সাহস নাই। কারণ ফটকা-পুঁজিপতিদের অর্থেই তো বহুসংখ্যক রাজনীতিকের রাজনীতি তথা নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ হয়। বাংলাদেশে আজ-অবৈধ অর্থের কাছে রাজনীতি বন্দী। অর্থ-ষড়যন্ত্রের বেড়াজালের বাইরে থেকে সুদীর্ঘকাল সফল রাজনীতি করে আজ জনাব আব্দুল হামিদ দেশের ‘প্রথম নাগরিকে’র আসনে উপবিষ্ট হয়েছেন। সত্য-কথন তাঁর মুখেই শোভা পায়। সমাজ তথা রাজনীতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ধোঁকাবাজি আর চাপাবাজির মহোৎসবে,জনাব আব্দুল হামিদ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটি নৈতিকতার আন্দোলনের সূচনা করেছেন। তাঁর সে যোগ্যতা আছে, সৎসাহস আছে, অবস্থান আছে। এতে রাজনীতিকরা ক্ষেপে গেলে, তাঁর কিছু আসে যায় না। এমন কি ভুয়া অপবাদ দিয়ে তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না, কারণ মানুষ সেসব বিশ^াস করবে না। ভুয়া মামলা দায়ের করে নাস্তানাবুদও করা যাবে না। কারণ রাষ্ট্রপ্রধান মামলা থেকে রক্ষিত। সারাজীবনে সত্যপ্রিয়তার বিজয়মুকুটে আরেকটি অনন্যপলক তিনি লাগাতে পারেন নৈতিকতার আন্দোলনে পৌরহিত্য করে।

রাষ্ট্রের ‘প্রথম নাগরিক’ জনাব আব্দুল হামিদ অবশ্য ভনিতা করে বলতে পারেন যে তাঁর তো মুখে ‘কুলুপ’ লাগানো। তিনি কথা বলবেন কেমন করে। এর জবাব তাঁর নিজের কথার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি বলেছেন, সমাবর্তনের সময়কালে তিনি কথা বলার একটা সুযোগ পান। খবর নিয়ে জানলাম, বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬০ থেকে১৬৫টি। ৩৬৫দিনে ১৬৫টি রসালো বক্তৃতা করার সুযোগ তো আপনার রয়েছে। এর অর্ধেক সমাবর্তনেও যদি যোগদান করেন, তাহলে হাস্যরসালাপের মধ্য দিয়ে নৈতিকতার অভিযানটি শুধু যে এগিয়ে নিতে পারবেন তাই না, বরং বিপুল সংখ্যক শ্রোতা সাধারণের মনের মর্মস্থলে সত্যালাপটি প্রোথিত করতে পারবেন। এর পেছনে একটা তত্ত্বকথা রয়েছে। একজন মিথ্যাচারী যদি অকাট্য সত্য কথাও বলে, কেউ তা বিশ^াস করে না। একজন সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তি যখন সহজাত ভঙ্গিতে সত্য কথা বলেন তখন তা মিথ্যাশ্রয়ী ব্যক্তিরও হৃদয়ে দাগ কেটে যায় আর সত্যশ্রয়ীরাও তো উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। ভালোকথার ফুলঝুরি ছোটানোর মানুষ বাংলাদেশে অনেক। তাদের ভালোকথায় কোন কাজ হয় না। ভালো মানুষের অভাব এদেশে প্রকট। এবিষয়ে একটি কেস্-স্টাডি বহুল আলোচিত। দর্শন-শাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত অধ্যপক একটি বিশ^বিদ্যালয়ে এলেন ভিজিটিং লেকচার দিতে। গুণমুগ্ধ শিক্ষকেরা তো এলেনই, সাথে কিছুসংখ্যক মেধাবীছাত্রও বক্তৃতা শুনতে হাজির হল। বক্তৃতার বিষয় ছিল, ‘ধৈর্য্য’। ধৈর্য্য কাকে বলে, কেমন করে ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়, ধৈর্য্যচুতি ঘটলে কিভাবে সামাল দিতে হবে, ধৈর্য্যশীলতার উপকার, ধৈর্য্যহীনতার ক্ষতি, বিভিন্ন ধর্মে ধৈর্য্য ধারনের ওপর শিক্ষা, লক্ষ্য অর্জনে ধৈর্যশীলতা ইত্যাদি বিষয়ে মনোমুগ্ধকর ভাষণ দিলেন অধ্যাপক। বক্তৃতা শেষে শ্রোতাদের প্রশ্ন ও আলোচনার পর্বে অধ্যাপক মহোদয় শ্রোতাম-লীকে আহ্বান জানালেন প্রশ্ন রাখার জন্য। এক মেধাবী ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বল্ল, “স্যার, প্রশ্ন করবো কি। প্রশ্ন করতে হলেতো বক্তৃতার কিছু সারবস্তু থাকতে হয়। আপনি তো শুধু কথার তুবড়ি ছোটালেন আপনার কথার কোন সারবস্তু নাই।” অধ্যাপক ছাত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলেন, “আস্ত গাধা কোথাকার! এসব উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় তুমি এসেছ কেন?” অধ্যাপকের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে উঠলো। ছাত্রটি এতটুকু বিব্রত না হয়ে আবার দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,“স্যার আপনি এতটুকুতেই রেগে গেলেন। ধৈর্য্য ধারণ করতে পারলেন না। আপনার কাছে ধৈর্য্য শিখবো কেমন করে?” এই বিখ্যাত অধ্যাপক ধৈর্য্যরে তত্ত্বকথা জানেন। বাস্তবে ধৈর্য্যধারণ করতে অভ্যস্ত হন নাই। তাত্ত্বিক আর ব্যবহারিক বা প্রয়োগিক শিক্ষার তফাৎ এখানেই।

কেউ একজন বলেছিলেন, বহুসংখ্যক সাহসী ভালোমানুষ না থাকলে, দেশ স্বাধীন হতে পারতো না। তবে সেই সব সুনাগরিকেরা অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন। যে ক’জন এরপরও বেঁচে ছিলেন, তাদের হত্যা করেছিলেন, জিয়া-মুশতাক তথা রাষ্ট্রবিরোধী পাকিস্তানী চরেরা। ষোল কোটি মানুষের দেশে মানুষের অভাব নেই, প্রকট অভাব রয়েছে মনুষত্বের। মা সন্তানকে হত্যা করছে। পিতা পুত্রকে হত্যা করছে। পুত্র পিতাকে হত্যা করছে। সন্তান ঘরে আরামে থেকে মা’কে গোয়াল ঘরে ঘুমাতে দিয়েছে। ‘প্রেমিক’ প্রেমিকাকে হত্যা করছে। প্রতিশোধের জন্য পড়শীর শিশু-সন্তানকে হত্যা করা হচ্ছে। বাস পথচারী হত্যা করছে। ধরতে গেলেই ধর্মঘট। প্রতিদিন সংবাদপত্র খুলতেই পাতাভরা শুধু হত্যা-নৃশংশতার কথা। অশান্তিকে ধরায় বসিয়ে দিয়ে শান্তি যেন অধরা হয়ে গেছে। কবি বলেছেনঃ ‘মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর’। সুর এবং অসুর উভয়ের উপাদান নিয়ে মানুষের জন্ম। সমাজে মনুষত্বের নেতৃত্ব থাকলে, পশু-প্রবৃত্তি দমন থাকে। সমাজে শান্তি বিরাজ করে। আবার সমাজে অসুরদের আধিপত্য বৃদ্ধি পেলে ভালোবাসা লোপ পায়, ঘৃণা-হিংসা-হিং¯্রতা সমাজে ধ্বংশ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এখন অসুরদের রাজত্ব চলছে। ব্যাংকে জনগণের টাকা লুটপাট করে অসুরেরা দোষ চাপাচ্ছে ব্যাংকের ওপর। লুটেরা-খেলাপীদের দুধকলা দিয়ে পোষা হচ্ছে আর বিপদে পড়েছেন ভালো ঋণগ্রহীতারা। শেয়ার বাজার জনগণের টাকা নিঃশেষে লুটে নিয়ে, লুটেরারা দোষ চাপাচ্ছেন বিনিয়োগকারীদের ওপর। প্রকল্পের অর্থ লুটপাট করে প্রকল্পের অধিমূল্যায়ন করে, ক্ষতি চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর। ঘুষ নামক ব্যাধিতো অফিস, আদালত সর্বত্রই। ঘুষ না দিলে ন্যায্য পাওনা না পাওয়ার ঘুষি খেতে হবে। কেন? দেশে কি ভালো মানুষ নাই? আছে। তারা দুর্বল, কারণ তারা অসংগঠিত। মহামান্য রাষ্টপতির ভাষায়, অসুরদের কঠিন একতা আছে। ভালো নাগরিকদের ঐক্যনাই। তাই ভালো মানুষ মার খাচ্ছে আর অসুরেরা দিব্যি লাঠি ঘোরাচ্ছে। এমন দুঃসময়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নৈতিকতার আহ্বান সভ্যসমাজে সাহস জোগাবে। রাষ্টপতি সত্যই বলেছেন, পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য। আমরা একমাস পেঁয়াজ না কিনলে, মজুতদাররা বাজারে দাম কমাতে বাধ্য হবে। তিনি শ্রোতা ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে বলেছেন, তোমরা নবীনেরা পেঁয়াজ না খাওয়ার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি আরও বলেছেন, চিলে কান নিয়েছের মত গুজব ছড়িয়ে লবণের দাম বাড়ানো হয়েছে- অসুরদের এটাই পদ্ধতি। রাষ্ট্রপতি গুজব নস্যাতের আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ছাত্রদের বলেছেন, আমরা খাঁচায় বন্দী, তোমরা, মিডিয়া সবাই মিলেশিক্ষা দাও। রাষ্টপতি আক্ষেপ করে বলেছেন, বড়দিনে ইউরোপ-আমেরিকায় জিনিষপত্রের দাম কমে, ঈদের সময় মধ্যপ্রাচ্যে জিনিষের মূল্য হ্রাস পায়। আর বাংলাদেশের অসুরেরা ঈদ-পার্বণ এলেই সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়। বুয়েটের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ইঞ্জিনিয়ারেরা রাস্তা তৈরী করা সুপারভাইজ করেন, কিন্তু কন্ট্রাক্টরের বিল পরিশোধের ক’দিন পরেই রাস্তার আস্তর উঠে যায়। ব্রিজ তৈরী হয়, অল্পদিনেই ভেঙ্গে যায়। বুয়েটের শিক্ষা কোথায় গেলো?

মূল কথা, সমাজে অসুরদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ব্যাংক লুটেরারা নাীতিনির্ধারণের দায়িত্ব কেড়ে নিয়েছে। লুটেরা-ধনিক শ্রেণীর হাতে রাজনীতি বন্দী। রাজনীতিকে মুক্ত করতে হলে অসুরদের বিরুদ্ধে সার্বিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। বরং জনগণের সরকারকে মুক্ত করার জন্য, চারপাশের অসুরদের বিতাড়ণের সামাজিক আন্দোলন। মহামন্য রাষ্ট্রপতির ভাষণে সে ইঙ্গিতই পাই। তাঁকে বেশী করে সামাজিক নৈতিকতার আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় চাই। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর কন্যার শুদ্ধি আন্দোলনে আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। শর্ষে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানো যায় না। তাই দলকে অসুরমুক্ত করতে হবে। তবেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে। সমাজে শান্তি, সহমর্মিতা, ন্যায় পরায়নতা পূণঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে। আমরা সব হারিয়ে এখন এই দুঃসাহসিক আশা নিয়ে বাঁচতে চাই।


Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে