Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

ব্রতচারী ও আমার ছেলেবেলা

ধু ধু মাঠ। এক পাশে বয়ে চলছে স্রোতস্বিনী খাল, যাকে স্থানীয় ভাষায় ছড়া বলে। অপরপাশে আমাদের শ্রীমঙ্গলের কচিকাঁচা ভবন। সেই মাঠে এক ঝাঁক ছোট্ট মেয়ে দু’হাত উপরে তুলে নৃত্যের তালেতালে চক্রাকারে ঘুরেঘুরে গাইছে-

[শিশু দোলে যাদের কোলে, তাদের জোরেই রাজ্য চলে।
অন্ধকারে থাকলে মা’রা মানুষ গঠন করবে কারা?
নারী যদি না পায় মুক্তি স্বাধীনতার বৃথাই যুক্তি]
মায়ের জাতের মুক্তি দেরে
নয়তো যাত্রা পথের বিজয় রথের
চক্র তোদের ঠেলবে কে রে?
জ্ঞানের আলো পায়না যারা
শক্তিবিহীন ব্যর্থ তারাÑ
শক্তিবিহীনমায়ের ছেলে
সকল কাজে যায় যে হেরে।

আবার ছেলে মেয়ের দল এক সঙ্গে নৃত্যেরতালেতালেগাইছেÑ

[বাংলাভাষী সকল মানুষ আমার পরম ইষ্ট
আমার প্রাণের গভীর প্রিয় বাংলাতে যা সৃষ্ট]
আমরা বাঙালী, সবাই বাংলা মা’র সন্তানÑ
বাংলা-ভূমির জল ও হাওয়ায় তৈরী মোদের প্রাণ,
মোদের দেহ, মোদের ভাষা, মোদের নাচ আর গানÑ
বাংলা-ভূমির মাটি হাওয়া জলেতে নির্মাণ,
বাংলাভূমি মোদের কাছে স্বর্গ-সম স্থান।
বাংলা-ভূমির ছন্দধারায় পালন করে মানÑ
দানব মোরা বিশ্বে মোদের বিশিষ্টতম দান।

এ হলো আমার ছেলেবেলা, এ হলো আমার কচি-কাঁচায় শরীরচর্চা। কচি-কাঁচার মেলা শিশুদের মায়ের তিনটি রূপ অর্থাৎ মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে শেখায়। ছোটবেলা থেকে তাই এই তিন মাকে ভালবেসেই আমরা বড় হই। কারণ, কচি-কাঁচার মেলায় যা কিছু শেখানো হয় সবই এ ত্রিমাত্রিক ভালবাসায় শিশুদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে।


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিজয় থেকে এ দেশের মানুষের মধ্যে দেশকে ভালবাসার, দেশের মানুষকে ভালবাসার চেতনা জেগে ওঠে। আর এ আবেগ আর চেতনার মধ্যে জন্ম নেয় শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা ১৯৫৬ সালের ৫ অক্টোবর। শিশুদের এ প্রাণের সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা রপ্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনÑকবি বেগম সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, পল্লীকবি জসিম উদ্দীন, বিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দিন, এম এ ওয়াদুদ-সহ আরও অনেকে। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই।

কচি-কাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো, শিশুরা যাতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে, বাঙালী সং¯ৃ‹তির প্রতি তাদের যাতে মমত্ববোধ জাগে, দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ করে। সর্বোপরি, তারা যাতে মানুষ হয়, মানুষকেভালবাসে।

কচি-কাঁচার মেলা শিশুদের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলছে, শিশুদের যুক্তি দিয়ে, নানাধরণের কর্মকাÐের মধ্যে যুক্ত রেখে সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে থেকেছে কচি-কাঁচার মেলা।

আজ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, কুটনীতিক, ব্যাংকার, সরকারী ও বেসরকারীভাবে শীর্ষ পদে আসীন ব্যক্তিবর্গের অনেকেই শৈশবে কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে ছিলেন।

স্বদেশ প্রেমিবাঙালী গুরুসদয় দত্ত দেশবাসিকে আদর্শ বাঙালী, আদর্শ বিশ্বমানব রূপে গড়ে তোলার সাধনা  করে গেছেন ব্রতচারী আন্দোলনের মাধ্যমে। এ আন্দোলনের মূলে ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও বাংলার স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। তিনি জাতিকে নিজেদের শাশ^ত ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়করিয়ে দেশপ্রেমি রূপে গড়ে তোলার প্রয়াশ চালিয়ে ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দেশবাসিকে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি ঘটাতে হবে, সাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
১৯৬২ সালে ঢাকার প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে দশদিনব্যাপী আনন্দমেলা ছিল কচি-কাঁচার মেলার একটি বড় আয়োজন।  নানাধরণের কর্মকাÐের মধ্যে ব্রতচারীনৃত্য এবং লাঠি খেলা ছিল অন্যতম আকর্ষণ। দাদাভাই নিজে ঢোল বাজাতেন। বাজাতেন লড়িনৃত্য পূর্ণতা পেতনা দাদাভাইয়ের ঢোলবাদন ছাড়া। এই আনন্দ মেলায় এসেছিলেন তৎকালীন প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শিল্পসংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও খেলাধুলার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলার প্রবর্তণ করে কচি-কাঁচার মেলা।  লাঠি খেলায় পারদর্শী কচি-কাঁচাদের ওস্তাদভাই কুষ্টিয়ার সিরাজুল হক চৌধুরী শিশু কিশোরদের লাঠি খেলা, কাঠি নৃত্য, লড়ি নৃত্য ও আত্মরক্ষার কলাকৌশল প্রশিক্ষণ দিতেন।

ব্রতচারী আন্দোলন স্বদেশীধারার শিল্প ও সংস্কৃতির পথিকৃত। কচি-কাঁচাদের ব্রতচারীর প্রশিক্ষণ দিতেন পটুয়া কামরুল হাসান। ব্রতচারী আন্দোলনের সদস্য শিশুসাহিত্যিক হাসানজান ও কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

শিশু-কিশোরদের সত্য ন্যায় ও সুন্দরের পথে আদর্শবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ৬৩ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে কচি-কাঁচার মেলা। এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কচি-কাঁচার মেলার প্রতিটি শিক্ষাশিবির, আনন্দমেলা বা সম্মেলনে  দেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থী ভাইবোনেরা অংশগ্রহণ করে আসছে। আর এতে নানাধরণের কর্মকাÐের মধ্যে ব্রতচারীনৃত্য এবং লাঠি খেলা থাকে অন্যতম বিষয় হিসাবে। ওস্তাদভাইয়ের অবর্তমানে উনার ছেলে ও মেয়ে প্রশিক্ষণ করাতেন। পরবর্তীতে ওস্তাদভাই কচি-কাঁচার মেলার প্রশিক্ষকবৃন্দ এবং উনার নাতনী লাঠিখেলা, কাঠিনৃত্য ও লড়িনৃত্যের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তেমনিভাবে পটুয়া কামরুল হাসানের অবর্তমানে মুন্সিগঞ্জ সৃজনী মেলার আওয়ালভাই, রেলওয়ে মেলার ইউসুফভাই ব্রতচারী নৃত্যের প্রশিক্ষন করাতেন। বর্তমানে ব্রতচারী সমিতির সদস্যবৃন্দ  প্রতিটি শিক্ষাশিবির, আনন্দমেলা এবং সম্মেলনে ব্রতচারী নৃত্যের প্রশিক্ষণ দিয়ে কচি-কাঁচার মেলাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
ব্রতচারী নৃত্যের জীবনোল্লাসের -
‘আয় মোরা সবাই মিলে গাহি তালে তালে’ অথবা  ‘চল কোদাল চালাই ভুলে মানের বালাই’
আবার সারি নৃত্যের-
‘কাইয়ে ধান খাইলো রে খেদানের মানুষ নাই,
খাওয়ার বেলায় আছে মানুষ কামের বেলায় নাই’,
লড়ি নৃত্যের-
সাবাশ সাবাশ সাবাশ ভাই,
বেশ বেশ বেশ ভাই’,
কাঠি নৃত্যের মাদলের বাজনা-
‘ধাতিন তাং ধাতিন তাং’ অথবা ‘কাঠি নাচ করিতে সবে রে ভাইরে ভাইরে’ - এ সুরগুলো এখনও কানে বাজে, শিহরণ জাগায়। ঢোলের ‘এক ধামা চাল একটি পটল’ ব্রতচারী ‘রাঁয়বেশের বোল ঝঁউর গিজার গিজা ঘিনিতা তাককুরাকুর ঘিজা ঘিনা -ফিরে যাই ছেলেবেলায়, সেই বিশাল মাঠে।

দেশের প্রায় সকল শিশুশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। পড়াশুনার পাশাপাশি গান, নৃত্য, আবৃত্তি, ছবিআঁকা, বিতর্ক,  বক্তৃতা করার সুযোগও যাতে সকল শিশু পায় তাও সরকারকে দেখতে হবে। তাহলেই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। কচি-কাঁচার মেলার মতো শিশুসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছেলেমেয়েরা বড়হচেছ সুস্থ চিন্তা, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে। শুধ ুশিল্প-সংস্কৃতিরচর্চা নয়, এর মধ্য দিয়ে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হচ্ছে। দেশপ্রেমিনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠছে। এ ধরনের শিশুসংগঠন যাতে সারা দেশে শাখা-প্রশাখা ছড়াতে পারে তাদের প্রতিও সহায়তার হাত বাড়াতে পারে সরকার।

১৯৭৩ সালে ব্রতচারী প্রশিক্ষন ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,-‘কামরুল তোমার কোন চিন্তা করতে হবেনা। আমি সমস্ত স্কুলে এই ব্রতচারী আন্দোলন চালু করে দেবো এবং বাঙালী একদম মনেপ্রাণে যাতে বাঙালী হয়, তোমাকে সেই কাজ করতে হবে। আমি আছি তোমার পিছনে।’ আজ দেশের প্রতিটি স্কুলে ক্লাব স্কাউট আছে, সরকারী অনুদান পাচ্ছে কিন্তু আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরার, মনেপ্রাণে বাঙালী হওয়ার মন্ত্র যে ব্রতচারীতে তা এখনও সকল স্কুলে চালু হয়নি, সরকারী অনুদানও প্রদান করা হচ্ছেনা।

আমি স্বপ্ন দেখি এবং বিশ^াস করি সারাদেশের প্রতিটি স্কুলে শরীরচর্চা হবে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের লাঠিখেলা, কাঠিনৃত্য, লড়িনৃত্য, ব্রতচারীনৃত্য। প্রতিটি স্কুলে সুস্থ চিন্তার সুস্থ সংস্কৃতির শিশুসংগঠন শাখা-প্রশাখা ছড়াবে। আর  এতে সহায়তা দেবে সরকার।

জয় সোনারবাংলা (জ সো বা), জয়তু ব্রতচারী। জয় হোক কচি-কাঁচার মেলার, জয় হোক কচি-কাঁচাদের।

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে