Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

করোনা প্রভাবে স্বাস্থ্য ও অর্থব্যবস্থা

                                                             করোনা প্রভাবে স্বাস্থ্য ও অর্থব্যবস্থা
                                                                          -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ


বছরের প্রথম দিকে করোনার আবির্ভাবে লোকজন হকচকিয়ে যায়। কারন রোগটি অচেনা,অপরিচিত। সতর্কতা মানতে গিয়ে অনেক মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। অফিস-ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় চলাচল নি¤œতম পর্যায়ে নেমে যায়। দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতায়,বন্ধুত্বের চর্চায় বিঘœ ঘটে, আত্মীয়তা ঝিমিয়ে পড়ে,পরিচিতজনেরা ও যেন অচেনা হয়ে ওঠে। কেউ কারো বাসায় যায় না। অফিস খোলার পরেও সবাই যেন লুকিয়ে থাকে। দোকান-পাট খুললো,কিন্তু ক্রেতার অভাব। ব্যাংক খুললো,কিন্তু ঢুকতে হবে একজন করে। বড় বড় শপিংমল খুলেছে-কিন্তু একসংগে প্রবেশ করবে কোথাও পাঁচজন,কোথাও দশজন। 


করোনা মানুষের চেহারাও পাল্টে দিয়েছে। মাস্ক দিয়ে নাক-মুখ ঢাকা। অনেকে মাথার চুল ঢেকেছে। কেউ আবার ফেস্শিল্ড পরেছে। দেখে চেনার উপায় নাই। মাস্কের ওপর নামটালিখে দিলে চিনতে সুবিধা হত। পরস্পরের দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারো মতে তিন ফুট। কারো মতে ছয় ফুট। নিয়মাচার মানতে মানতে কখন যে আমরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি,পেছন ফিরে না তাকালে বোঝার উপায় নাই। তবে বাংলাদেশের করোনার একটা বৈশিষ্ট রয়েছে,যা উল্লেখ না করলে করোনার প্রাতি অবিচার করা হবে। বৈশিষ্ট্যটা একটা কৌতূকের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করছি। 


আমরা সবাই জানি, করোনা সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে চীনের উহান প্রদেশ থেকে। আমারা এও জানি যে একই জিনিস বিভিন্ন মানে তৈরি এবং বিভিন্ন মূল্যে বিক্রীর দক্ষতা চীনাদের মধ্যেই দেখা যায়। যে দেশ বেশী দামে কিনতে চায়,তারা ভালোমানের পন্য পাবে। আবার একই রকম দেখতে কম দামে পাবে,যারা সস্তায় চায়। করোনা বিতরনেও চীন একই পদ্ধতি গ্রহন করেছিল। সর্বোচ্চ শ্রেনীর করোনা প্রেরীত হয়েছিল আমেরিকায়। দ্বিতীয় শ্রেনীরটা পাঠানো হয় ইওরোপসহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে। আর নিস্তেজ শ্রেনীর করোনা এসেছিল বাংলাদেশে বন্ধুত্বের নির্দশনা হিসাবে। তাই কোন কোন উন্নত দেশে মৃতের হার ১২% ছাড়িয়েছে। মধ্যম দেশগুলেতে করেনার মৃত্যুহার ৮ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। আর বাংলাদেশে মৃত্যুহার দেড় শতাংশের ও কম। সারা পৃথিবীতে করোনায় মৃত্যুহারের গড় হলো ৫% এর একটু বেশী। চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের নিগুঢ়রহস্যের প্রকাশ করোনার মৃত্যুহারে। ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্ব আরো দৃঢ়তর হয়েছে কিনা বলতে পারবো না,স্বল্প মৃত্যুর কারনে বাংলাদেশে করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্টি প্রদর্শনা করার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্যবিদেরা যতই মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন, জনগন ততই তা উপেক্ষা করতে পছন্দ করছে। কেউ বলছেন , নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আবার কেউ বলছেন,নিশ্বাসে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আবার প্রশ্বাসের সাথে শরীরে ঢুকে ক্ষতি করছে। হ্যন্ডগেøøাভস ক্ষুদ্র মহলে প্রচলন শুরু হয়েছিল। এখন প্রায় বন্ধ। 


করোনায় মৃত্যুর সাথে সাথে স্বাস্থ্যহানী ঘটেছে। যারা আক্রান্ত হয়েছেন,তারা সেরে উঠলে ও স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে খাবারে পুষ্টিমান বজায় রাখা সবার সাধ্যে কুলায় না। স্বাস্থ্য সমস্যা ব্যাপকতর হয়েছে অর্থনৈতিক কারনে। সেজন্যেই স্বাস্থ্য এবং অর্থব্যবস্থা একসাথে বোঝার চেষ্টা করছি।
স্মরণ করা যাক করোনার শুরুর দিনগুলোর কথা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার  নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিল। কারন রোগটি সম্বন্ধেঅভিজ্ঞতা দুরের কথা, কোন ধারনাই ছিল না আমাদের। এক ধরনের ভীতির সৃষ্টি হল। রোগীর কাছে গেলেই রোগ হবে। ভাবখানা এমন যে,রোগীর দিকে তাকালেই বুঝি রোগ হয়ে যাবে! শুরু হলো বিচ্ছিন্নতা। অফিস-আদালত,দোকান-পাট,ব্যবসা বাণিজ্য সব বন্ধ। গার্মেন্টসসহ বড় শিল্প বন্ধ। হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকা ছাড়ছে। অন্যান্য শ্রমিক কর্মচারীরা বেকার। মধ্যপর্য্যায়ের অনেকে ছাটাই এর শিকার। ঢাকায় ‘টু লেট’ নোটিশে ভরে গেল। সবাই গ্রামমুখী। এই পরিস্থিতির অর্থনৈতিক বিশ্লেষন করা যাক। 


যারা দিন আনে,দিন খায়,তারা উপোষ। সরকার তাদের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রোগ্রাম হাতে নিল। প্রথমদিকে রান্না করা খাবার পৌছে দেয়া অনহারীর কাছে। কাজটি সুকঠিন। কিছুটা সহজ হল একারনে যে, নি¤œআয়ের সবাই না-খাওয়া। শিগগীরই প্রকাশ পেলো,শুধু দারিদ্ররাই নায়,নি¤œ মধ্যবিওরা ও অনেকে উপোষ। রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি এসে খাবার সংগ্রহ করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বাজেটের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছেÑব্যয়ের পথে কিছু টাকা লুট হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। হয়তো হবে। অর্থব্যবস্থার অদক্ষতায় লুট হয়ে থাকে। তবে আমাদের কাছে ক্ষুধা নিবৃত্তির প্রশ্ন অধিক গুরুত্ব বহন করেছিল। তাই ব্যয়-অপব্যয় সহ ক্ষুধানিবৃওির কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছিল।

করোনার ক্ষতি হিসাবায়ন এখনো গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌছায়নি। তবে আর্ন্তজাতিক সংস্থার হিসেব মতে করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ২০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৯% হয়েছে। অতিদারিদ্রের হারও ১০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুন অংক ছাড়িয়েছে। এই তথ্যটুকু থেকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বড় একটা দিক উম্মোচিত হবে। এই শতাব্দির প্রথমে বাংলাদেশের দারিদ্রের হার কমবেশী ৪০% ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টার ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখেন। ফলে ক্রমাগত উন্নতি হতে হতে ২০% নেমে আসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরো কমিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র-হারের নীচে নামানোর সংকল্প ব্যাক্ত করেছিলেন। উল্লেখ্য, মার্কিন মুলুকের মত ঐশ^র্য্যশালী দেশের দারিদ্রহার তখন ১৬% ছিল। কিন্তু করোনার আক্রমনে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।

দারিদ্রহার বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি বড় কারন সরকার অনুসৃত ভ‚ল অর্থনীতি। বাজার অর্থনীতি নিয়ে সমস্যা নেই। বাজার অর্থনীতির ব্যষ্টির মধ্যে কয়েক প্রকার ভিন্ন অর্থনীতি রয়েছে। বজার অর্থনীতিকে একটি সরলরেখা (continuity) কল্পনা করলে, সর্বডানে রয়েছে ‘পূঁজিবাদী অর্থনীতি,’ মাঝে রয়েছে ‘কল্যান অর্থনীতি’ এবং সর্ববামে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’। শেষোক্তটি আবার দুইপ্রকারÑ কম্যুনিষ্ট অর্থনীতি এবং অকম্যুনিষ্ট সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’। এ সবই কমবেশি বাজার অর্থনীতিতে চলমান। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য ‘কল্যান অর্থনীতি’ অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে এই নীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, ‘মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না, আয়-বৈষম্য থাকবে না।’ এখানে থাকবে না বলতে সর্বনি¤েœ থাকবে বোঝান হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার একদিকে মুজিব-বর্ষ পালন করছে। অন্যেিদক মুজিবের অর্থনীতির একদম উল্টোদিকে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশে এখন মানুষে মানুষে আয়বৈষম্য চরমপর্যায়ে রয়েছে। জিনি সহগ বেড়ে এখন প্রায় দশমিক পাঁচ। অন্যদিকে পালমা অনুপাতেও পালমা অনুপাত  এখন বিপর্যয়কর তিন। ফলে অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশ এখন চরম আয় বৈষম্যের দেশ। সরকার শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি তো জনসংখ্যার বড়জোর দশভাগের মধ্যে সীমিত। নব্বই ভাগ মানুষ আয় বৈষম্যের শিকার, যা বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি এবং দেশের সংবিধানের মূলনীতির সাথে সংঘাতপূর্ণ।

বৈষম্যের বিষয় অন্যদিন আলোচনা হবে। আজ বৈষম্যর ফলাফল নিয়ে কথা বলব। গত দুইযুগের ক্রমাগত তীব্র আয় বৈষম্যের ফলে শকতরা দশভাগ লোক অতি ধনী, আরো দশভাগ ধনী হয়েছে। তারপরের কুড়ি ভাগকে বলা যায় মধ্যবিত্ত। বাকি ষাট ভাগের মধ্যে চল্লিশ ভাগ সরাসরি দারিদ্র এবং বাকী ২০ভাগ তথাকথিত নি¤œবিত্ত। করোনার ফলে পরিসংখ্যানে বাস্তব চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। ৪০% মানুষ সম্বলহীন আর বিশভাগ মানুষ স্বল্পবিত্ত। অর্থাৎ দেশের ৬০% বিত্ত সংকটে।

এ পরিস্থিতিতে করনীয় কি?আমরা ধরে নিচ্ছি করোনা আর বেশী জ¦ালাবে না। পূনরাবৃত্তি হলে করনীয় ও ভিন্ন। যে ক্ষতি হয়েছে, সেটুকু পূরণ করার উপায় নিয়ে কথা বলব। বিত্ত হারাতে যত সময় লাগে, বিত্ত গড়তে অনেক বেশী সময় প্রয়োজন। ইংরেজীতে বলে, Slow but steady wins the race। শ্লথ হলেও লেগে থাকলে জেতা যায়। প্রথমেই দেশের বাজেটের দিকে তাকাতে হবে। করোনার নামে ব্যয়-অপব্যয় যা হয়েছে, তা কিভাবে পূরন হবে?

আমাদের বাজেটে সেফটি-নেট হিসাবে ২০% বিত্তহীনের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। বর্তমান সরকার আসার পর থেকে এই প্রোগ্রামগুলোতে অর্থায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে. যদি ও তা যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতিতে বিত্তহীনের সংখ্যা বেড়ে ৩৯% হলে, সেফটি নেট প্রোগ্রামে অর্থ বরাদ্দ সরাসরি দ্বিগুণ করতে হবে। সেটা করতে গেলে অন্যান্য খাতে বরাদ্দ কমাতে হবে। খাত সমন্বয়ের এই কাজটা সহজ হবে না।

আরো কয়েকটি বাস্তব অবস্থার দিকে নজর দেয়া যাক। অনেক মানুষ চাকুরীচ্যুত বা কর্মচ্যুত হয়েছেন। তাদের পূনর্নিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। গার্মেন্ট শিল্প মোটামুটি চলছে। কিন্তু অনেক বৃহৎ-মাঝারি শিল্প এখনো গতি পায়নি। ঢালাও ব্যবস্থা না নিয়ে এগুলোকে চিহ্নিত করে, প্রতিটির সমস্যা অনুযায়ী সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ। এজন্য এটি টাস্ক-ফোর্স কাজ করতে পার। তবে স্বনিয়োজিতদের সমস্যা ভিন্ন। শুধু ঋণ দিলেই হবে না। এদের জন্য ভিন্ন একটি টাস্ক-ফোর্স হতে পারে। যারা উদ্যোক্তাদের সংগে আলাপ করে সমাধানের নির্দেশনা দেবেন এবং পরিপালনে সহায়তা করবেন। কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে কৃষি-শিল্প ও হস্ত-শিল্পের জন্য সংযোগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনকে দায়িত্ব এবং তহবিল প্রদান করা যেতে পারে।

সরকার বেশ কিছু ঋণ সুবিধা দিয়েছেন। তবে ঋণ কিন্তু সর্বদদ্রæহুতাশন নয়। ঋণের সাথে অন্যবিধ সহযোগিতা ও টেকনিকাল সাপোর্ট প্রয়োজন। এ জন্য বিভিন্ন সেক্টরের জন্য সংস্থা চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং উদ্যোক্তাদের সাথে লিংকেজ সৃষ্টির ব্যবস্থা নেয়া দরকার। 


সবশেষে মূল সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছি। যতক্ষন পর্যন্ত জাতীয় আয়ের সমতা-ভিত্তিক বন্টন নিশ্চিত না হবে, ততক্ষন পর্যন্ত এই সমস্যা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। এ জনেই বঙ্গবন্ধু ‘আয় ও সম্পদের সমবন্টনের’ কথা বলেছিলেন। সংবিধানে লিখেও দিয়েছিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক নীতিমালা অবজ্ঞা করে ‘বল্গাহীন পূঁজিবাদের’ নীতি গ্রহণ ও চর্চ্চা করছি। এই ব্যবস্থায় নি¤œ-আয়ের ৪০% মানুষ ‘রোজ-আনা রোজ-খাওয়া’ পর্যায়ে থেকে যাবে। এক মাস চলার মত সঞ্চয় ও তাদের থাকবে না। সেইসাথে মোটা হতে থাকবে শীর্ষ দশভাগ মানুষ। সরকার কি নীতি পাল্টাতে পারবে? সরকার কি ‘মোটাতাজা মানুষদের’ কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? সরকার কি বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতিতে ফেরৎ যেতে পারবে? আজ শুধু প্রশ্ন রেখেই শেষ করছি।  




    

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে