স্বপ্নভঙ্গের ২০২০
সৈয়দা কানিতা মাঈশা
২০২০ সালের মত এমন কোন অঘটনঘটনপটীয়সী সালের জুড়ি মেলা ভার। বছরের শুরুটা আর অন্যসব বছরের মত নিরীহ হলেও মার্চ আসতে না আসতেই আতঙ্কের অশনি সংকেত জানান দিয়ে গেল যে এ বছরটা হতে চলেছে রুদ্ধশ্বাসে পরিবর্তনের দিকে পথচলার এক বছর। মহামারী দেশের প্রতিটি পরিবারের জীবনেই আনল পরিবর্তনের ঝড়। আমরা কেউ হারালাম আমাদের অতি প্রিয়জনদের, কারো পরিবার মাসের পর মাস যুদ্ধ করলো করোনা নামক এক অলক্ষুণে ভাইরাসের সাথে, আবার কারো পরিবারে নেমে এলো অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। ছোট ছোট কচি কাঁচাদের জীবনেও আসলো পরিবর্তন। নেই স্কুল, নেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা, চারদেয়ালের গণ্ডির মাঝেই আবদ্ধ হয়ে গেল ছোট সোনামণিদের জীবন।
এই অনিশ্চয়তার হাত থেকে নিস্তার পেল না কচি কাঁচাদের বছরসেরা অনুষ্ঠানগুলোও। বিগত বছরের ৯ই এপ্রিল কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী ছিল। অন্য যেকোনো বছরে যেই সময়টায় কচি কাঁচারা তাদের প্রাণপ্রিয় দাদাভাইয়ের স্মরণে গান, নাচ, আবৃতি দিয়ে মেলা প্রাঙ্গণ মুখরিত করত, সকলের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এ বছর সেই সময়টায় কচি কাঁচারা ছিল নীরব। পহেলা বৈশাখ, যেদিন রঙের ঝড় ছিটিয়ে কচি কাঁচাদের হাতে মেলা হয় রঙিন, এবার সেই দিনটিও ছিল যারপরনাই নিরানন্দ।
কিন্তু যত অনিশ্চয়তার সময়ই আসুক না কেন, কচি কাঁচারা দমে যাওয়ার পাত্র না। মাসখানেক যেতে না যেতেই কচি কাঁচারা চিন্তা করলো, মেলার মঞ্চে অনুষ্ঠান হবে না তো কী হয়েছে, এবার অনলাইন অনুষ্ঠান নিয়ে তাহলে কচি কাঁচারাই নতুন করে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। আর এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল কচি কাঁচাদের অনলাইন পরিবেশনা। কেউ বাসার ছাদে নৃত্য পরিবেশন করে, কেউবা নিজের ঘরে গান করে, সব পরিবেশনা ভিডিও করে মেলার ফেসবুক পেইজ থেকে লাইভ প্রোগ্রাম করার মাধ্যমে কচি কাঁচারা জানান দিয়ে গেল যে কচি কাঁচারা হার মানতে জানে না। ফলাফলঃ কচি কাঁচাঃ ০১; করোনাঃ ০০। আর এরপর থেকে শুধু কচি কাঁচাদের এগিয়ে যাওয়ার পালা।
দাদাভাইয়ের জন্মদিন আর পহেলা বৈশাখ- ২০২০ সালের এ দুটি অনুষ্ঠানই বা তাহলে বাদ থাকবে কেন? যেহেতু তখনও অনলাইন আয়োজন সম্ভব হয়নি, আজ তাই লেখালেখির মাধ্যমেই স্মরণ করা যাক কচি কাঁচাদের অতিপ্রিয় এই দিন দুটিকে।
দাদাভাইয়ের জন্মদিন
২০২০ সালের ৯ই এপ্রিল কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খানের ৯৫ তম জন্মবার্ষিকী ছিল। সবার কাছে তিনি বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক, লেখক ও সংগঠক,কিন্তু আমাদের কাছে তিনি আমাদের প্রাণের দাদাভাই, কচি কাঁচাদের দেখলেই যার মুখে ফুটে উঠত গালভরা হাসি আর চোখভরা স্বপ্ন- কচি কাঁচাদের নিয়ে এক সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।
কচি কাঁচাদের মধ্যে যারা দাদাভাইকে দেখনি, তারাও কিন্তু দাদাভাইকে চেনো তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। ছোটবেলার হাট্টিমা টিম টিম ছড়ার কথা মনে আছে? অথবা খোকন খোকন ডাক পাড়ি? আমাদের ছোটবেলার এই প্রিয় ছড়াগুলো কিন্তু দাদাভাইয়ের লেখা। হাট্টিমা টিম টিমের মত আজগুবি সব চরিত্রের পেছনে যেই মানুষটি ছিল, সেই মানুষটিও কিন্তু ছিল বেশ মজার। ছোটবেলায় হাট্টিমা টিম টিমের চার লাইন শুনেছি আমরা সবাই, কিন্তু ছড়াটি কিন্তু মোটেও চার লাইনের নয়। ৫২ লাইনের এই ছড়াটার প্রতিটি লাইনই হাট্টিমা টিম টিমেরআজগুবি সব গল্পে ভর্তি।
হাট্টিমা টিম টিম
রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই
টাট্টুকে আজ আনতে দিলাম
বাজার
থেকে শিম
মনের
ভুলে আনল কিনে
মস্ত
একটা ডিম।
বলল এটা ফ্রি পেয়েছে
নেয়নি
কোনো দাম
ফুটলে
বাঘের ছা বেরোবে
করবে
ঘরের কাম।
সন্ধ্যা সকাল যখন দেখো
দিচ্ছে
ডিমে তা
ডিম
ফুটে আজ বের হয়েছে
লম্বা
দুটো পা।
উল্টে দিয়ে পানির কলস
উল্টে
দিয়ে হাড়ি
আজব দু'পা বেড়ায় ঘুরে
গাঁয়ের
যত বাড়ি।
সপ্তা বাদে ডিমের থেকে
বের হল
দুই হাত
কুপি
জ্বালায় দিনের শেষে
যখন
নামে রাত।
উঠোন ঝাড়ে বাসন মাজে
করে
ঘরের কাম
দেখলে
সবাই রেগে মরে
বলে
এবার থাম।
চোখ না থাকায় এ দুর্গতি
ডিমের
কি দোষ ভাই
উঠোন
ঝেড়ে ময়লা ধুলায়
ঘর করে
বোঝাই।
বাসন মেজে সামলে রাখে
ময়লা
ফেলার ভাঁড়ে
কাণ্ড
দেখে টাট্টু বাড়ি
নিজের
মাথায় মারে।
শিঙের দেখা মিলল ডিমে
মাস
খানিকের মাঝে
কেমনতর
ডিম তা নিয়ে
বসলো বিচার সাঁঝে।
গাঁয়ের মোড়ল পান চিবিয়ে
বলল
বিচার শেষ
এই
গাঁয়ে ডিম আর রবে না
তবেই
হবে বেশ।
মনের দুখে ঘর ছেড়ে ডিম
চলল
একা হেঁটে
গাছের
সাথে ধাক্কা খেয়ে
ডিম
গেলো হায় ফেটে।
গাঁয়ের মানুষ একসাথে সব;
সবাই
ভয়ে হিম
ডিম
ফেটে যা বের হল তা
হাট্টিমাটিম
টিম।
হাট্টিমাটিম টিম-
তারা
মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের
খাড়া দুটো শিং
তারা
হাট্টিমাটিম টিম।
গত বছর দাদাভাইয়ের জন্মদিন পালন করা হল না তো কী হয়েছে? চাইলে কিন্তু আমরা কচি কাঁচারা এখনও দাদাভাইকে স্মরণ করতে পারি। তোমরা যারা ছড়া অথবা গান ভালোবাসো, দাদাভাইয়ের লেখা ছড়ার বইগুলোতে একটু ঢুঁ মেরে আসতে পারো। কে জানে? হয়তো তোমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেহাট্টিমা টিম টিমের চেয়েও মজার কোন ছড়া! আর যারা ছবি আঁকতে পছন্দ কর, চাইলে আজগুবি এই হাট্টিমা টিম টিমের ছবি এঁকে ফেলতে পারো তোমার নিজের কল্পনার জাদুতে।
পহেলা বৈশাখ
চলছে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। করোনার কারণে বিগত পহেলা বৈশাখটাও আমাদের সবার কেটেছে একটু নিরানন্দ আমেজেই। চার দেয়ালের মধ্যে বদ্ধ হয়েই নতুন বছরকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলাম আমরা সবাই। অন্যান্য বছর দেখা যেত পহেলা বৈশাখের মাসখানেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে যেত বর্ষবরণের দক্ষজজ্ঞ। বিশালাকৃতির রঙিন মুখোশ, কিম্ভূতকিমাকার পেঁচা, রঙিন প্রজাপতি অথবা পিঠা উৎসবে মায়েদের তৈরি মজাদার সব পিঠার মৌ মৌগন্ধে জমজমাট থাকত মেলা প্রাঙ্গণ। তবে পুরো উৎসবের মুখ্য আকর্ষণ ছিল বর্ণিল পোশাকে মেলাকে রাঙ্গিয়ে তোলা কচি কাঁচারা আর উচ্ছ্বসিত জয়ধ্বনি দিয়ে তাদের বর্ষবরণ। ২০২০ সালে তা হয়নি তো কী হয়েছে? আশা রাখছি বিগত বছরের সব গ্লানি মুছে আগামী বছরটি কচি কাঁচাদের জন্য নবসম্ভাবনার ছোঁয়া নিয়ে আসবে। আবার পূর্ণ উদ্যমে কচি কাঁচারা গেয়ে উঠবে – এসো হে বৈশাখ, এসো হে এসো।
আর ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গোণার পালা। নতুন বছর আমাদের সকলের জন্য শুভ হোক। জয় হোক কচি কাঁচার মেলার আর জয় হোক কচি কাঁচাদের।
0 Comments