-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
একজন গণমানুষের ব্যাংকার ছিলেন লুৎফর রহমান সরকার। গণমানুষের সাথে ব্যাংকের সম্পর্ক ক্ষীন। ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা ধনিক বনিক শ্রেণীর মানুষ। আমানতকারীরা ও স্বচ্ছল মানুষ। আমানতকারী আর ঋণগ্রহীতাদের নিয়েই ব্যাংকের কার্যক্রম। তাই ব্যাংকারদের চলাফেরা ওঠাবসা উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের সাথে। গণমানুষের সাথে তাদের পরিচিতি থাকে না। পেশাদার ব্যাংকারদের লক্ষ্য থাকে ব্যাংকের বিত্তবান মালিক, সচ্ছল গ্রাহক আর মুনাফা অর্জনের দিকে। ব্যাংকের এই প্রচলিত গন্ডির বাইরে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন লুৎফর রহমান সরকার।
গতশতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে করাচীর হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে প্রবেশনারি অফিসার হিসাবে ব্যাকিং পেশায় যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতোকোত্তর ডিগ্রীধারী এই মেধারী তরুন। উচ্চবিত্তে গন্ডিবদ্ধ ব্যাংকিং ব্যবস্থাতেই তার প্রশিক্ষণ এবং পথচলা শুরু হয়েছিল। বিত্তচক্রে ক্যরিয়ার গড়ে তোলার উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন তিনি। অন্যান্য সবার মতই। ব্যতিক্রম ছিল তার প্রবল তারুণ্যে, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বে আর সাবলীল আলাপচারিতায়। সফলতাও অর্জন করেছিলেন অল্প সময়ে। ১৯৬৫ সালে নবগঠিত স্টান্ডার্ড ব্যাংকে উচ্চ নির্বাহীপদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। বিত্তচক্রেই আবর্তিত হচ্ছিলেন এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হবার পর ব্যাংক জাতীয়করণ করা হলো। লুৎফর রহমান সরকার ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ব রূপালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নিযুক্ত হলেন। তার পেশাগত দর্শনের পরিবর্তন সম্ভবত: সেখান থেকেই। এতদিন যে ‘ক্লাস-ব্যাংকিং’ তিনি করে এসেছিলেন, তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। ÔMass-banking’ এর নতুন উপলদ্ধিতে তিনি সোচ্চার হলেন। তিনি সুবক্তা ছিলেন। সামাজিক সমাবেশে গণ-ব্যাংকিয়ের কথা বলতে লাগলেন। তিনি সুলেখক ছিলেন। লেখার মাধ্যমে ও তিনি ছড়িয়ে দিতে লাগলেন তার উপলদ্ধি। ব্যাংকের নির্বাহী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে তার উপলদ্ধির প্রয়োগ ঘটাতেও সচেষ্ট হলেন। কাজটি সহজ ছিল না। সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাংকের বন্ধ দরজা খোলার কাজে তার সৃজনশীলতা লক্ষনীয়। সেবা দিতে হলে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি পৌছাতে হবে। তাই গ্রামগঞ্জে দ্রুত ব্যাংকশাখা সম্প্রসারণের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য সরকারী নীতি ও এ ব্যপারে সহায়ক হয়েছিল। গ্রামের অর্থনীতি অনুধাবন, তদনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যাংকারদের মানসিক পরিবর্তন আনয়নের জন্য আমরা কয়েকজন মিলে যে ‘প্রশিক্ষণ টিম’ গঠন করেছিলাম এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে কর্ম পরিচালনা করেছিলাম, লুৎফর রহমান সরকার সেই টিমের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
জনসম্পৃক্ততার জন্য তিনি গ্রাহক সমাবেশ প্রচলন করেছিলেন। গ্রাহক তথা জনসাধারণের সামনে দাঁড় করিয়ে তিনি ব্যাংকারদের অন্তর্মুখিতা ভেঙে দিতেন। গনবিমুখতা থেকে সেকেলে ব্যাংকারদের বের করে আনার প্রয়াসে যারা অবদান রেখেছিলেন, তিনি তাদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন। ১৯৭৬ সালে জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে পদোন্নতি পেয়ে অগ্রনী ব্যাংকে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা ও কর্মক্ষেত্রের পরিধি বিস্তৃত হলো।
একটি ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ছে। স্বাধীন দেশে পল্লী অঞ্চলে শাখাবিস্তার এবং কৃষিসহ গ্রামীন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ঋনদান সরকারের ঘোষিত নীতি। অথচ ব্যাংকগুলো চলছে পকিস্তানী আমলের Book of Instructions এর ভিত্তিতে। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঐ বইতে ‘কৃষিকাজে ঋনদান নিষেধ ও শাস্তিযোগ্য’ লেখা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে লুৎফর রহমান সরকার আমাকে অনুরোধ করলেন স্বাধীন দেশের নীতিমালার আলোকে অগ্রনী ব্যাংকের জন্য সম্পূর্ণ নতুন করে যুগোপযোগী বুক অব ইন্সট্রাকশন প্রণয়ন করার জন্য। কাজটি কঠিন ছিল। আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। ঐ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেকটর ছিলেন জনাব ফজলুর রহমান। মেধাবী কিন্তু সেকেলে। তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার তো দু:সাহস কম না। জানো, পাকিস্তানী কয়েকটি ব্যাংকের BBI লিখেছিলেন বিদেশী পরামর্শক। যেখানে ডেভিল ঢুকতে ভয় পায়, তুমি সেপথে হাটতে চাচ্ছ?’ জনাব সরকার তাকে থামিয়ে বল্লেন, ‘দায়িত্ব আমার। খালেদ আমার তত্ত্বাবধানে BBI লিখবে।’ আমার জেদ চেপে বসলো। সরকার সাহেবের তত্ত্বাবধানে নয়, বরং তার প্রোটেকশনে থেকে তিনমাস দিনরাত পরিশ্রম করে স্বাধীন দেশের উপযোগী করে যে Book of Instructions প্রনয়ন করেছিলাম, আজ ও পর্যন্ত বাংলাদেশে সেটাই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রচনা। পরিবর্তীতে পরিবর্ধিত সংস্কারণ ও প্রকাশ করেছিলাম। লুৎফর রহমান সরকার আগলে না রাখলে প্রাচীনপন্থী মুরুব্বীদের বিদ্বেষবানে আমি জর্জরিত হতাম। এমন কি যুগোপযোগী নির্দেশগ্রন্থটি ব্যাংক প্রকাশ করতো কি না, সে সন্দেহ আমার ছিল।
অনেক স্মৃতি ভিড় করছে। স্বাধীনতার পরেই আমরা ক’জন তরুন ব্যাংকার ভারতের প্রশিক্ষন ব্যবস্থা দেখার জন্য বোম্বাই গিয়েছিলাম। লুৎফর রহমান সরকার, সৈয়দ আলী কবির, মোস্তফা ওয়ায়েজ সহ বেশ কয়েকজন ছিলেন। ভারতীয় ব্যাংকারবৃন্দ আমাদের সংবর্ধণা দিল এক সন্ধ্যায়। বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর নৈশভোজের আয়োজন ছিল। সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতে ভারতীয়রা তাদের জাতীয় সংগীত গাইলো। তারপর আহবান জানালো আমাদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের জন্য। আমরা কেউ গায়ক নই। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। লুৎফর রহমান সরকার দৃপ্তপদে ষ্টেজে উঠে আমাদের ডাকলেন। আমরা সম্ভবত: দু’জন ষ্টেজে উঠেছিলাম। জাতীয় সংগীতের চার লাইন গেয়ে সদ্যস্বাধীন দেশের সম্মান রক্ষা করালাম। তার নেতৃত্বগুনে সে যাত্রায় বেঁেচ গেলাম। আড্ডায় বসে এক ভারতীয় তাকে প্রশ্ন করলো, ‘যাদুকর পি.সি.সরকার কি তোমর আত্মীয়?’ সরকার সাহেব ‘না’ বলে ও মুক্তি পেলেন না। ওদের মতে ‘সরকার’ মানেই যাদুকর। অতএব যাদু দেখাতেই হবে। সপ্রতিভ সরকার দমলেন না। হাতের রুমাল নিয়ে কিছু হাত-ছাফাই দেখালেন। যে কোন পরিস্থিতি সামাল দেবার মানসিকতা এবং যোগ্যতা ও তাঁর ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্কুল-ছাত্রদের ব্যাংকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়াসে জনাব সরকার স্কুল-ব্যাংকিং এর প্রসার ঘটিয়েছিলেন। ক্ষুদ্রঋন বিতরণেও তার সাফল্য ছিল। কৃষিঋণ বিতরণে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। খুব সফল না হলেও শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব খোলার সূচনা তিনি করেছিলেন। রিকশাচালকদের রিকশামালিক বানানোর লক্ষ্যে তিনি ব্যপকভাবে রিকশা-ঋন দিয়েছেন। ঠেলাগাড়ীর চালকদের ও ছোট ছোট ঋন দিয়েছেন। ভ্যানচালকদের ঋনদানে তিনিই গতিসঞ্চার করেছিলেন। তাঁর ব্যাংকিং কর্মকান্ডে এভাবেই গণমুখীতা ফুটে ওঠে।
শিক্ষার প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। ছাত্রদের প্রয়োগিক শিক্ষা প্রদান এবং কর্মসংস্থানেও তাঁর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্য অনুষদের খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। বানিজ্য অনুষদের ছাত্রদের শিক্ষাশেষে তাদের প্রয়োগিক শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে তিনিই প্রথম ব্যাংকে ব্যপকভাবে ইন্টার্নশীপ প্রোগ্রাম প্রচলন করেছিলেন।
বুয়েট, মেডিকেল ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী অর্জনের পর শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাংকে বেশ কিছু প্রকল্পের প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তিনি করেছিলেন। মূল সার্টিফিকেট জমা রেখে বিনা জামানতে ঋন প্রদানের প্রচলন তাঁরই কীর্তি। তাঁর প্রবর্তিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘বিকল্প’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় অনেক ডেন্টাল ক্লিনিক, ডাক্তারদের চেম্বার, ক্ষুদ্র ব্যবসা স্থাপিত হয়েছিল। অনেক বাস রাস্তায় নেমেছিল। ছাত্রদের মালিকানায় ট্যাক্সিক্যাব ও চালু হয়েছিল অনেক। স্বচ্ছতার সাথে ছাত্র নির্বাচন করা হতো এই প্রকল্পে। অভিযোগ রয়েছে জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার রাজনৈতিক দলগঠনের সুবিধার্থে তাদের পছন্দমত ছাত্র নির্বাচনের প্রস্তাব করলে লুৎফর রহমান সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরশাদ সরকার রুষ্ট হয়ে সামরিক আইনে বিচার করে তাকে জেলে প্রেরণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এরশাদ সরকার তখনকার প্রবীন সৎ, দক্ষ ও সজ্জন ব্যাংকারদের জেলে পাঠিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আলী কবির, মুশফিকুস সালেহীন এবং সুলেমান চৌধুরীর মত প্রথিতযশা ব্যাংকারবৃন্দ। সেরা ব্যাংকারদের বদনাম দেয়াটা ব্যাংক বিরাষ্ট্রীকরণের কোন কৌশল ছিল কি না, এ নিয়ে নিবিড় গবেষনা হতে পারে। তবে বিরাষ্ট্রীকরণের জন্য এ ধরণের অপকৌশলের প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না।
জেল থেকে বেরিয়ে লুৎফর রহমান সরকার ব্যক্তিখাতের ইসলামী ব্যাংক এবং প্রাইম ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ও পালন করেছেন পরবর্তীকালে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে লুৎফর রহমান সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসাবে নিয়োগদান করে। এরশাদ সরকার তাকে যেভাবে অপদস্থ করেছিল, তাঁর কিছুটা হলেও মোচনের প্রয়াস ছিল এই নিয়োগের মাধ্যমে। গণমানুষের ব্যাংকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে পদায়ন সুধিমহলে সমাদৃত হয়েছিল।
লুৎফর রহমান সরকার একজন সুসাহিত্যিক ছিলেন। পেশাগত লেখা ছাড়াও রম্যরচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ছড়া লিখেছেন অনেক। লিটল ম্যগাজিনের মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা তথা লেখক সৃষ্টির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। কর্মজীবন থেকে তাঁর অবসর গ্রহণের পর লিটল ম্যগাজিনের প্রকাশ ও হ্রাস পেয়েছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।
বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে শারীরিক অসুস্থাতায় আক্রান্ত হয়ে অনেকটা বিস্মৃতির অন্তরালে বাস করতে থাকেন। নব প্রজন্মের ব্যাংকাররা ও বুঝি ভূলতে বসেছিল এই খ্যাতিমান অগ্রজকে। তিনি ও হয়তো অভিমানে দূরে সরে থাকতেন। অনেকদিন পর তাঁর উত্তরসূরি গভর্ণর ড. আতিউর রহমান বুঝি বিবেকের দায় অনুভব করলেন। ২০১০ সালে ৮ ডিসেম্বর তারিখে তাঁরই উদ্যোগে ইনসটিটিউট অব ব্যাংকার্স এবং ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন যৌথভাবে সকল ব্যাংকের পক্ষ থেকে লুৎফর রহমান সরকারকে সম্মাননা জানালেন হোটেল র্যডিসনে এক মনোরম সন্ধ্যায়। প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী জনাব এ এম এ মুহিত। লুৎফর রহমান সরকার এসছিলেন হুইল চেয়ারে বসে। হুইল চেয়ার বসেই স্টেজে তোলা হয়েছিল তাকে। হুইল চেয়ারে বসেই মাইকের সামনে সামান্য দু’কথা বলতে পেরেছিলেন। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মুখের চিরচেনা হাসিটি ছিল অমলিন। সম্মাননা জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। আর বিনয়ের সাথে বলেছিলেন, “সম্মাননার যোগ্য আমি নই। যা করেছি, দায়িত্ব পালনের জন্যই করেছি।” শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, গণমানুষের প্রতি এমন দায়িত্ববোধ কজনের থাকে। প্রানচঞ্চল, সদাহাস্যমুখ, বিনয়ী এবং কর্মমুখর এই মানুষটি এরপর আর জনসমক্ষে আসেননি।
0 Comments