খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
সাবেক চেয়ার প্রফেসর, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট
উনষাট থেকে তেষট্রি সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়েছি। ফজলুল হক হলে থেকেছি। কিছুকাল আবাসিক। তারপর অনাবাসিক। সময়ের আগ্রাসনে অনেক স্মৃতিই ঝাপসা হয়ে আসছে। তারপর ও আনন্দঘন বিশ^বিদ্যালয় জীবনের কিছু স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভাসছে। কিছু কথা যেন এখনো কানে বাজছে। তেমনি কিছু টুকরো স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্ট করব অনেকদিন পর।
সে সময় হল সংসদের নির্বাচন হত নিয়মিত। সাধারণ ছাত্ররা ভোট দিত মেধার ভিত্তিতে। প্রার্থীরা ছোট ছোট কাগজে নিজেদের ক্রেডেনশিয়াল লিখে বিতরণ করতেন। লেখা থাকতো ম্যাাট্রিক আর ইন্টারমিটিয়েটের রেজাল্ট। মেরিট তালিকায় কত নম্বরে অবস্থান ছিল। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিশেষ নৈপূন্য ছিল কি না। পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়টি ও উল্লেখ করা হত। প্রার্থী নিজে প্রাঙ্গণে বা অশেপাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেন। জড় হতো ভোটারবৃন্দ। দু’একজন সমর্থক উপস্থিত ভোটারদের মাঝে ‘ক্রেডেনশিয়াল’ বিতরণ করতেন। একজন প্রার্থী শেষ করার পর প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যেতেন একইভাবে। মারামারি নাই, লাঠালাঠি নাই, চাপাবাজি ও নাই। ভোটে জিততো সবচেয়ে কৃতী প্রার্থী। সে সময় একবছর ফজলুল হক হল সংসদের সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন আজকের প্রবীন অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম। সম্ভবত: তার আগের বছর ভিপি বা জি.এস হয়েছিলেন পরবর্তীকালের পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ।
একটি মজার ঘটনা স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠছে। একজন ধর্মান্ধ ছাত্র ছিলেন। নামটা মনে পড়ছে না। তিনি আক্ষরিক অর্থে ধর্ম বুঝতেন। অপব্যখ্যাও করতেন। এ নিয়ে ঝামেলা হতো না। সবাই তাকে নিয়ে মজা করতেন। তিনি অন্যের রসিকতা বুঝতেন না। নিজের মত করে কথা বলেই যেতেন। একদিন শোনা গেল তিনি একটা বই লিখেছেন। বইটির নাম “সূর্য্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে”। হলে একটি প্রকাশনা সভা করে ছাত্রদের বোঝালেন, ‘বিজ্ঞানীরা ভূল করছেন। পৃথিবী মোটেই সূর্য্যরে চারপাশে ঘোরে না। বরং পৃথিবী স্থির দাঁড়িয়ে। সূর্য্যই পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করছে। তিনি ধর্ম-পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে অপব্যখ্যা করছিলেন। তিনি নাকি ঐশীজ্ঞানে এটা বুঝতে পেরেছেন। প্রকাশনা সভায় বাকবিতন্ডা হয়নি। সবাই ‘পাগল’ নিয়ে মজা করেছেন।
আমরা দু’তিন বন্ধু মিলে এই রসালো ঘটনায় আরেকটু রস ঢেলে দিলাম। রাতের মধ্যে একটা দেয়াল পত্রিকা লিখে ফেল্লাম। একটি কার্টুন আর একটি লেখা। লেখার নাম ছিল সম্ভবত: ‘সূর্য ঘোরে না, পৃথিবী ঘোরে না, মাথা ঘোরে’। শেষ রাতে দেয়ালে টানিয়ে, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলায় হুলস্থল। হাসাহাসি. রং তামাশা, বাক্যবান। কোন গোলমাল হয়নি। বইটির লেখক অবস্থা বেগতিক দেখে রুম থেকে কেটে পড়েছেন। সরাদিন ফেরেন নাই। তার সাথে কেউই বিরূপ ব্যবহার করেনি। এ রকম সহশীলতা কি আজকের দিনে দেখা যায়?
আরো একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। হলে প্রতিবছর বার্ষিক ডিনার হতো। আপ্যায়নের সাথে বিনোদন ছিল। সঙ্গীত পরিবেশন ইত্যাদি। অনুষ্ঠানটিকে আকর্ষনীয় করার জন্য একজন বিশিষ্ট অতিথিকে আমন্ত্রন করা হতো। একবার আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর মোনায়েম খানকে। আমরা তখন ছাত্রত্ব শেষ করে বেরিয়ে পড়েছি। শুনলাম, ছাত্রদের আপত্তি স্বত্বেও এন.এস.এফ কাজটি করেছিল। আমি ছিলাম না। দেখিও নি। অনেক ছাত্র ও নাকি ডিনার বয়কট করেছিল। লাট বাহাদুর এসে ডিনার স্পিচ দিয়েছিলেন। খেতে খেতে অনেক কথা বলেছিলেন। পরদিন তার যে মুখরোচক কথাগুলো ছাত্ররা ছড়িয়েছিল, তা অনেকটা এরকম, ‘প্রিয় ছাত্রগণ, তোমাদের হল প্রাঙ্গনটির চারপাশে তোমরা সুন্দরভাবে ফুলগাছ লাগিয়েছ। তোমাদের একটি মূল্যবান উপদেশ দিচ্ছি। তোমাদের হাতে দু’পয়সা থাকলে, এক পয়সার ফুল কিনবে আর এক পয়সার খাবার খাবে। তাই তোমাদের হল প্রাঙ্গণের একপাশে ফুল গাছ লাগবে, অন্যপাশে উত্তম জাতের কলাগাছ লাগবে, যাতে করে সকালবেলা নাশতার সাথে সবাই সুস্বাদু কলা খেতে পার ।’ এই ঘটনা নিয়ে রসাত্মক আলোচনা বেশ কিছুদিন ছাত্রদের বিনোদনের চাহিদা মিটিয়েছিল।
0 Comments