বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দর্শন
-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ¯্রষ্ঠা। জীবন বাজি রেখে তিনি যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন, তার প্রথম পর্যায়ে বিজয় এসেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর সশস্ত্রসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। বাহাত্তর সালের ১০ জানুযায়ী বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি দেশ গঠনের কঠিন কাজে হাত দিয়ে ছিলেন। নতুন রাষ্ট্রের গঠন এবং পরিচালনার জন্য জাতির জনক কিছু দর্শন ধারন করেছিলেন, যার ভিত্তিতে কিছু মূলনীতি ঘোষণা করেছিলেন। মূলনীতিসমূহকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে ভাগ করা যায়। রাজনৈতিক মূলনীতি ছিল ‘বাঙালী জাতিয়তাবাদ’ অর্থাৎ বাংলাদেশে বসবাসরত জনগোষ্ঠিকে নিয়ে গঠিত নতুন রাষ্ট্রের নাড়ির স্পন্দন হবে বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও গৌরববোধ। সেইসাথে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপরিচালনা করাও ছিল আরেকটি রাজনৈতিক মূলনীতি। সামাজিক মূলনীতি ছিল সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান এবং এবিষয়ে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা।রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মূলনীতির সঙ্গা ছিল, মানুষে মানুষে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বিলোপ সাধন, যা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র হিসাবে সঙ্গায়িত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু নতুন রাষ্ট্রের দর্শন শুধু বক্তৃতা- বিবৃতিতেই প্রকাশ করেননি, সেই সাথে রাষ্ট্রের সংবিধানে ‘রাষ্ট্রীয় মূলনীতি’ হিসাবে সংযোজন করেছিলেন। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপক্ষেতা এবং সমাজতন্ত্র -এই চার মূলনীতি সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক মূলনীতি হিসাবে সমাজতন্ত্রই সংবিধানের নির্দেশনা।
দেখা যাক, সংবিধানের অর্থনৈতিক দর্শন কিভাবে সঙ্গায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, “ আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন,
মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” এই প্রস্তাবনার সাথে সঙ্গতি রেখে সংবিধানের ৮(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের জন্য ‘সমাজতন্ত্র’ রাষ্টীয় মূলনীতি বলে পরিগণিত হবে।
সমাজতন্ত্রের প্রয়োগিক নির্দেশনা দিয়ে সংবিধানের ১৮ (২) ধারায় বর্ণিত হয়েছে, “ মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ- সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”
কট্টর ‘কম্যুনিজম সমাজতন্ত্রে’ সকল সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে থাকে। কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ সম্পদের উপর রাষ্ট্রের একক মালিকানা থাকে না এবং ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত থাকে। এই বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, “উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন-ব্যবস্থা ও বন্টন প্রনালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবে জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা ব্যবস্থা হইবেঃ (ক) রাষ্ট্রের মালিকানা....., (খ) সমবায়ী মালিকানা...... এবং (গ) ব্যক্তি মালিকানা.......।” উল্লেখ্য, সমবায়ী ও ব্যক্তিমালিকানা এই উভয়বিধ মালিকানাই রাষ্ট্রের মালিকানার আওতা বহির্ভূত। সংবিধানের এই ধারাকে ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় মালিকানার সমন্বয় প্রচেষ্টা হিসাবে গণ্য করা যায়।
সংবিধানের ১৪ ধারায় বর্ণিত হয়েছে, “ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিককে, এবং- জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।” উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু সবসময়ই শোষণ থেকে মুক্তির কথা বলতেন। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, “মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।” এর অর্থই ছিল পরাধীনতার গøানি, শোষণ ও অবিচার থেকে মুক্ত করা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, প্রকৃত
মুক্তি অর্জন নয়। এ কারণেই ক্ষেত্র প্রস্তুতের পর প্রকৃত মুক্তি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে সংবিধানের এই ১৪ ধারাটি সন্নিবেশিত হয়েছিল, যা জাতির জন্য সার্বক্ষনিক সাংবিধানিক নিদের্শনা।
বর্নিত সাংবিধানিক নির্দেশনার আলোকে বৈষম্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কিছু উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি একাধিকবার বক্তৃতায় বলেছেন, ‘বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত, শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘কৃষক- শ্রমিক ও বঞ্চিত জনগনের পক্ষে আমি........... দেশে শোষনমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে আমাদের কাজ।’ বাহাত্তর সালের মার্চ মাসে একটি নীতিনির্ধারনী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “মানুষে মানুষে সামাজিক বৈষম্য, মানুষে মানুষে আয় ও সম্পদ বৈষম্য দূর করাই আমাদের নীতি।” এখানে দূর করার অর্থ বৈষম্য হ্রাস করার কথাই তিনি বলেছিলেন। প্রতীয়মান হচ্ছে, জাতির জনকের বক্তব্য এবং রাষ্ট্রের সংবিধানের নির্দেশনা একই সূত্রে গাঁথা।
বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারী দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তাঁর বক্তব্য নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়নের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করলেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ তথা ভূমি সংস্কারের প্রচেষ্টায় নজর দিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি ‘কৃষি বিল্পবের’ ডাক দিয়েছিলেন, যা সবুজ বিল্পব নামেও পরিচিত। ঐ ডাকে সাড়া দিয়ে সকল অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা হল। ঢাকার ধানমন্ডির মত অভিজাত এলাকায় তখন এক বিঘা প্লটের অর্ধেকে ছোট্ট বাড়ী, আর বাকী অর্ধেক খালি ছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে খালি জায়গায় শাক- সবজিতে ভরে উঠলো। অনেক রাস্তার দু’পাশে শবজী ফলন শুরু হল। এমন কি ক্যান্টনমেন্টগুলোর বিস্তর খালি জায়গায় সিপাহীরা ধানচাষ শুরু করে দিলেন। কৃষি দপ্তর সুগঠিত করার কাজ শুরু হল। স্বাধীনতার আগে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ষাট ভাগ ধানচালের চাহিদা মিটতো। আজ ষোল কোটিমানুষের শতভাগ খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। সূচনাটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে।
কৃষক, শ্রমিক তথা অবহেলিত মানুষদের সাথে বিত্তবানদের আয় তথা সম্পদ বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এবার বঙ্গবন্ধু সুসংবদ্ধ এবং কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। এটি ছিল বহুল আলোচিত ‘বাকশাল’ কর্মসূচী। বাকশাল সম্বন্ধে অনেক মিথ্যা প্রচারণা হয়েছে। প্রচারিত হয়েছে, এর মাধ্যমে সরকার কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করবেন। এবং একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। এ ছিল অবৈধ মিথ্যা প্রচারনা, বঙ্গবন্ধুকে জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে। প্রকৃতপক্ষে বাকশাল ছিল একটি সমবায় পদ্ধতি। কৃষকরাই নিজ নিজ সমবায় গঠন করবেন। তাদের মালিকানার তাদের নিজস্ব সমবায়ের জমিগুলো তাদের নিজস্ব তত্ত¡াবধানে একসাথে চাষ করা হবে। যার যার মালিকানার অংশের সমপরিমান ফসল কৃষকেরা পাবেন। জমির মালিক কৃষক না হলে, তাকে ও এই পদ্ধতিতে আসতে হবে বলা যেতে পারে, ব্যক্তিমালিকানায় সমবায় পদ্ধতিতে চাষ হবে, ব্যবস্থাপনা হবে এবং ফসল বিতরণ হবে। তবে সবাইকে ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য আয়ের একটি অংশ দিতে হবে। পুরো বাকশাল পদ্ধতিতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোয়ার সৃষ্টির ব্যবস্থা ছিল। যেমন, গ্রামে কেউ কর্মহীন থাকবে না। যার জমি বা সম্পদ নাই, সেও সমবায় কর্মে শ্রম দান করবে এবং মজুরি পাবে। এইভাবে গ্রামের শ্রম শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র সম্পূর্ণ নির্মুল করার পরিকল্পনা ছিল বাকশাল কর্মসূচীতে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তকারীদের চক্রান্তে বাকশাল কার্যকর হল না। উল্লেখ্য, সংবিধানের ১৩ ধারায় যে ‘সমবায়’ খাত নির্দেশিত হয়েছিল, তারই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ছিল বাকশাল কর্মসূচী। বঙ্গবন্ধু যা বলতেন, তাই করতেন। স্বাধীনতা চেয়েছেন, স¦াধীনতা এনেছেন। বৈষম্য দূর করার কথা বলেছেন, বাকশালের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছেন। দু’টি পদক্ষেপই তিনি নিয়েছিলেন নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। প্রথম বার অর্জন করেছেন। দ্বিতীয়বার প্রাণ বির্সজন দিয়েছেন, কিন্তু পিছ- পা হননি।
পঁচাত্তরের সহিংস অভ্যুথানের ফলে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন, চার জাতীয় নেতা নিহত হলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অত্যাচারে নিস্পেষিত করা হল। সেই সাথে বঙ্গবন্ধুররাজনৈতিক,
সামাজিক তথা অর্থনৈতিক নীতিসমূহ পাল্টে ফেলা হল। দেশকে পাকিস্তানি ধাঁচে বাংলা স্থানবানানোর প্রচেষ্টা হল। সম্প্রদায়কতা উস্কে দেওয়া হল। অর্থনৈতিকভাবে আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী ও লক্ষ্য উল্টে দিয়ে ‘কট্টর পুজিবাদ’ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী গৃহীত হয়। ধনী আরো ধনী হতে লাগলো। গরীব আরো গরীব এবং নিঃস্ব হতে লাগলো। সেই সাথে সন্ত্রাসী শক্তির বিকাশ ঘটলো। এমনকি সরকার নিজেই সন্ত্রাসী হয়ে উঠলো। ৬৪ জেলায় একসাথে বোমা বিস্ফোরণ ; অর্থমন্ত্রী- কিবরিয়া, বৃটিশ রাষ্ট্রদূত, বিচারকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপর হামলা ও হত্যা ; রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা ; গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় শক্তিশালী বোমা বিষ্ফোরণ প্রচেষ্টা ; এবং একুশে আগষ্ট গুলিস্থানে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে হামলায় নৃশংস হত্যা ও রক্তপাতের মত ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছে পচাঁত্তর- উত্তর সন্ত্রাসী রাজনৈতিক শক্তি। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সাথে সাথে সামাজিক সন্ত্রাস বিস্তার লাভ করলো। সামাজিক অপশক্তিগুলো সংখ্যালঘুদের মন্দিরে মূর্তী ভাঙা, আগুন দেয়া থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের ভিটে- মাটি থেকে উচ্ছেদ, সম্পত্তি জবর দখল এবং দাঙ্গা- হাঙ্গামা বাধানোর কাজে লিপ্ত হলো। সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হল। পচাঁত্তরের অপশক্তি সমূহের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে ছিল (১) ব্যাংকে জনগণের আমানত লুন্ঠন (২) কালোবাজারী চোরাকারবারীর মাধ্যমে বিশাল অংকের কালো টাকা তৈরী এবং (৩) ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা তথা প্রসাশনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে দেয়া।
২০০০ শতকের প্রথম দশকে পঁচাত্তরের পঁচা-শক্তির বিদায় ঘটলেও সরকারের বিভিন্ন স্তরে লুকিয়ে থেকে অনিষ্ট করে চলেছিল অপশক্তি আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষত কিছুটা পুনরুদ্ধার করেছে। দেশকে বাংলাস্থান থেকে বাংলাদেশে রূপান্তর করেছে। স্বাধীনতার সশস্ত্র শত্রæদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দিয়েছে। বড় শত্রæদের মৃত্যুদন্ড ও কার্যকর হয়েছে। বোমা-হামলা, সন্ত্রাস অনেকটা বন্ধ হয়েছে। মূর্তীভাঙা ও সাম্প্রদায়িক বিচ্ছেদ অনেকটা
লাঘব হয়েছে। তবে রাজনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর ‘মানুষে মানুষে আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাসের’ নীতিমালা এখনো উপেক্ষিত। ধনে- সম্পদে ‘মোটাতাজাকরন’ এখন সরকারী নীতি এবং কালোটাকা প্রবৃদ্ধি এখনো বাস্তবতা।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন ও নীতিমালা কিভাবে এখানো উপেক্ষিত হয়ে চলেছে, তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। বর্তমান সরকারের নেতৃবৃন্দ তাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও নীতিমালা সম্বন্ধে বলে থাকেন, “দেশে কেউ না খেয়ে থাকবে না। দারিদ্র কমিয়ে আনা আমাদের লক্ষ্য।” আবার কখনো উচ্চারিত হয়, “বাসস্থলহীন কেউ থাকবে না, কেউ অনাহারে থাকবে না।” এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণ ছিল, “মানুষে মানুষে আয় ও সম্পদ বৈষম্য থাকবে না। অঞ্চল অঞ্চলে উন্নয়ন বৈষম্য থাকবে না।” বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণের সাথে বর্তমানের উচ্চারণের পার্থক্য সুস্পষ্ট। বর্তমান সরকারঅনাহারকে গুরুত্ব দিচ্ছেন আর বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দিয়েছেন আয় ও সম্পদের বৈষম্যকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয় সম্পদ বৈষম্য পর্বত প্রমান, কিন্তু সেখানে অনাহারে কেউ মরে না। এটাই কি বর্তমান সরকারের আদর্শ ? মনে রাখতে হবে বিশ্বের সম্পদের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে বৈষম্য থাকলেও দারিদ্র কম থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের মত ঘন বসতি পূর্ণ স্বল্প আয়ের দেশে এই উদাহরণ জুতসই নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তিন- চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্রের হার ছিল ১৭%। করোনার পর এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে পূর্ব সময়ে দারিদ্রের হার ২০% ছিল, যা এখন ৩৯% এ দাড়িয়েছে। বিশাল ঐশ্বর্যের অধিকারী হলেও উলঙ্গ পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্রের হার খুব একটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তাই অর্থনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আদর্শ হতে পারে না।
এখন শাসকদের মুখে ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটা উচ্চারিতই হয় না, যদিও সমাজতন্ত্র চর্চায় সংাবধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সম্ভবত সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা নাই। শব্দটির অর্থের
ব্যপকতার ব্যাপারে সঠিক অনুধাবনের অভাব রয়েছে। বিষয়টি বুঝেই বঙ্গবন্ধু ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটির গ্রহনযোগ্য ব্যাখা প্রদান করেছের। পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন “আমাদের সমাজতন্ত্র চীন বা রাশিয়ার সমাজতন্ত্র নয়, কম্যুনিজম নয়। আমাদের সমাজতন্ত্র আমাদের মাটি থেকে উঠে আসা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র।” বিষয়টির একটি তাত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করা আবশ্যক মনে করছি। ‘বাজার অর্থনীতি’ ব্যাপক অর্থবোধক একটি ধারণা, যা continuity বা একটি সরল রেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। মুক্ত বাজার সরল রেখাটির সর্ববামে রয়েছে ‘কমিউনিজম বা কম্যুনিজম শাসন।’ উদাহরণ চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ। মুক্ত বাজার সরল রেখার মধ্যবিন্দুতে রয়েছে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বা কল্যাণ অর্থনীতি। উদাহরণ, সুইডেন সহ ইউরোপের স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রাষ্ট্রসমূহ। মুক্ত বাজার সরলরেখার সর্ব ডানে রয়েছে কট্টর পূঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র। উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্। এই তিন প্রকার অর্থনীতিই বাজার অর্থনীতি। শুধুমাত্র কট্টর পূঁজিবাদী অর্থনীতিকেই কেবলমাত্র বাজার অর্থনীতি বলার অবকাশ নাই। চীন এবং রাশিয়া বাজার অর্থনীতিই চর্চা করছে। মধ্যপন্থী কল্যাণ অর্থনীতি তো বাজার অর্থনীতিরই ফসল।
বিলেতের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা স্যার উইলিয়াম বিভারিজ সর্বপ্রথম কল্যাণ অর্থনীতির ধারনা নিজ দেশ গ্রেট ব্রটেনে প্রয়োগ করেন আজ থেকে শতবর্ষেরও বেশী আগে। বেকার ভাতাসহ দারিদ্র- সহায়ক অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য হয়ে ওঠে ঐ সময়কার আধুনিক ‘গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ বা ওয়েলফেয়ার স্টেট হিসাবে। কল্যাণ রাষ্ট্রে বাজেটের বিরাট অংশ ব্যয় করা হয় জনকল্যাণে। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা জনগণের অধিকার। রাষ্ট্র এসব খাতে সহায়তার দায়বদ্ধ। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও ভারসাম্যমুলক কল্যাণ অর্থনীতি বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দেশ হল ইউরোপের, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক প্রভৃতি রাষ্ট্র। এমন কি জার্মানী ও কল্যাণ রাষ্ট্রের ভূমিকায় অগ্রগামী। এসব দেশে অর্থনৈতিক নীতিমালা বাস্তবায়নে ‘কঠোর’ সুশাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। বাজার অর্থনীতির প্রধান তিনটি অবস্থান (ক) কট্টর পূঁজিবাদ (খ) কল্যান অর্থনীতি বা গন
তান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং (গ) কম্যুনিজম নির্নয়ে মানুষে মানুষে আয় সম্পদের বৈষম্য পরিমাপের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদদেরা জিনি সহগ (Geni co- efficient) ব্যবহার করেন। জিনি সহগ দশমিক তিন এর আশেপাশে হলে মানুষে মানুষে আয় বৈষম্য নি¤œতম বলে ধরা হয়। জিনি সহগ পাঁচ এর আশেপাশে থাকলে বা অতিক্রম করলে আয় বৈষম্য উচ্চমাত্রায় বলঅ হয়, সেক্ষেত্রে দেশটি বিরাট বৈষম্যের দেশ হিসেবে পরিচিত হবে। পূর্বে বর্নিত সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কজিনি সহগ দীর্ঘদিন বাবৎ দশমিক তিন এর আশেপাশে এবং দশমিক চার এর নীচে অবস্থান করছে। এ তিনটিই মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ। তাদের অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষ্যই হল বৈষম্যহীন, শোসনহীন সমাজ। গিনি সহগের বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান পর্যলোচনা করা যায়। ১৯৭২ সালে বিআইডিএস সমীক্ষায় বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল দশমিক তিন দুই। অর্থাৎ আমরা দারিদ্র হলেও সুষম সমাজে বাস করতাম। জিডিপি বৃদ্ধির সাথে জিনি সহগ দশমিক চার অতিক্রম করে ২০১০ সালে .৪৪ এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালেে হাইজহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেনাডচার সার্ভে অনুযায়ী জিনি-সহগ দশমিক ‘চার- আট- তিন’ ( .৪৮৩) এ দারিয়েছে। অনেকের ধারনা দীর্ঘ চার বছরে জিনি- সহগের প্রক্ষেপন দশমিক পাঁচ অতিক্রম করে যেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি সহনশীল বৈষম্যের দেশ থেকে বিরাট বৈষম্যের দেশে রুপান্তরিত হয়েছে এবং সরকারের অর্থনৈতিক নীতির কারনে তা চলমান।
ধনী গোষ্ঠির কোন রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে না। তারা ধনী হবার বাসনায় রাজনীতি করেন। অতি ধনী হবার পর সব ধনীর এক না। জামাতি ধনী, বিএনপির ধনী, জাতীয় পার্টির ধনী এবং আওয়ামী ধনী, সবাই নিজ ও গোষ্টি স্বার্থে এক। সবদলের ধনীরা মিলেই ধনিক শ্রেনী। তারা তাদের অবস্থান বজায় রাখতে হয়ে যায় দলহীন ধনিক গোষ্ঠি। তারা এক হয়ে অর্থশক্তিতে বলিয়ান হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ব করে। সরকার যতই জনবিচ্ছিন্ন হয়, ততই তাদের ধনিক শ্রেনী নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
নাগরিকদের আয়- সম্পদ বৈষম্য বাড়তে থাকে। সম্পদ পুঞ্জিভূত হতে থাকে অসংখ্যক মানুষের হাতে।
বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থার দিক নজর দেয়া যাক। ২০১৮ সালে ধনী ব্যক্তিদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। বাংলাদেশে অতি ধনীদের সংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল ১৭%, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের চেয়ে অনেক বেশী। সম্পদ ভীষনভাবে পুঞ্জিভূত না হলে, এটা হত না। ধনীর হার বৃদ্ধির ফলে আয়- সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং হতদরিদ্ররা মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে জাতীয় আয় বা জিডিপি-র প্রবৃদ্ধি ৮% ছাড়িয়েছিল, যা রীতিমত ঈর্ষনীয়। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া সহ বাংলাদেশের আসে পাশের কোন দেশ এদেশের ধারে কাছে নেই। তাহলে এই প্রবৃদ্ধিও টাকা কোথায় গেল? সরকারের প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা পএে বের হয়ে এসেছে যে, প্রবৃদ্ধির অর্থ প্রধাণত পুঞ্জিভূত হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আয়কারী ৫% মানুষের হাতে। এর অর্থ দাড়ায় দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ প্রবৃদ্ধির আণুপাতিক ভাগ পায় না। জনপ্রতি গড় আয় বাংলাদেশে বেশীই হবে, কারণ জাতীয় আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই মাথাপিছু আয় বেরিয়ে আসে। যেহেতু জনপ্রতি গড় আয় কোন ব্যক্তিরই প্রকৃত আয় নয়, সেহেতু এই সংখ্যা প্রকৃত আয়ের তথ্য গোপন করে। ধরা যাক, একজনের আয় দশ কোটি টাকা, অন্যজনের আয় দশ হাজার টাকা। তাহলে, মাথাপিছু গয় আয় দাঁড়াবে ৫ কোটি ৫ হাজার টাকা। কিন্তু দশ হাজার টাকা আয়ের ব্যক্তিটির আয় কি গড় আয়ে প্রকাশ পায়? যেদেশে অতি ধণী ব্যক্তিদের সংখ্যাবৃদ্ধি পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করে, আয়কে কোনভাবেই প্রতিনিধিত্ব করে না। যিনিসহগ বিশ্লেষনের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বাংলাদেশ এখন চরম আয়-সম্পদ বৈষমের দেশ। ক্রস-চেক করার লক্ষ্যে ‘পালমা অনুপাত’ পরীক্ষা কওে দেখতে পারি। পালমা অনুপাত হল, দেশের নি¤œআয়ের চল্লিশ শতাংশ মানুষের মোট আয়ের কতগুণ
বেশী সর্বোচ্চআয়ের দশ শতাংশ মানুষের মোট আয় , সেই অনুপাত। এই অনুপাত ১ থেকে ২ এর মধ্যে হলে বৈষম্যকে সহনীয় বলা যায়। ২ থেকে ৩ এর মধ্যে থাকলে আয় বৈষম্য লক্ষণীয়। অনুপাত ৩ অতিক্রম করলে চরম বৈষম্য প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৯৮০ এর দশকে পালমা অনুপাত ছিল ১.৬৬ ; নব্বই এর দশকে বৃদ্ধি পেয়ে অনুপাতটি দাঁড়ায় ২.১ এর কাছাকাছি। বর্তমান শতাব্দির প্রথম দশকে এটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২.৫৬। ট্রেন্ড বিশ্লেষণ কওে প্রক্ষেপণ করলে, বর্তমানে পালমা অনুপাত ৩ ছাড়িয়ে যাবে। যিনি সহগ যেমন দশমিক ৫ এর কাছাকাছি, তেমনি পালমা অনুপাতও ৩ ছাড়িয়েছে। কাজেই বাংলাদেশে মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য যে চরম ও অহনীয় পর্যায়ে পৌছেছে, তাতে কোন সন্দেহ নাই।
বাংলাদেশের চরম বৈষম্যের মূলে রয়েছে ক্রোনি-ক্যাপিটালিজম, যা বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ বা কল্যাণ অর্থনীতির বিপরীত মেরু। ৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কল্যাণ অর্থনীতি চর্চা করেছেন। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা ও অর্থ লোলুপ চক্র ক্রোনি- জপিটালিমকে তাদেও অর্থনীতি হিসাবে গ্রহন করে। ক্রোনি- জপিটালিজমের বদৌলতে ঘুষ-দুনীতি- কালোটাকার বাংলাদেশ ভওে ওঠে। বিদেশী দু’টি ষ্টাডিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কালোটাকার পরিমান নির্ণেয় চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি ষ্টাডিতে জিডিপির সর্বনি¤œ ৩০ শতাংশ এক অন্য ষ্টাডিতে জিডিপির সর্বনি¤œ ৩৩% শতাংশ কালোটাকা রয়েছে বলে ধারনা করা হয়। প্রতিবছরই এই পরিমান নতুন কালোটাকা তৈরী হয়, যাতে কওে জাতীয় অনুপাতে বজায় থাকে, অর্থাৎ জাতীয় আয়ের কম বেশী এক তৃতীয়াংশ কালোটাকা থেকে যায়।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের পটভূমিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতির উলট-পালট নিয়ে তথ্যনির্ভর কিছু আলোচনা করা হয়েছে। পরিশেষে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ধ্যান- ধারনা প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান নিয়ে সার্বিক মূল্যায়ন করা যেতে পারে। পচাত্তওে আগষ্টে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সহ
সব দর্শণ তথা ধ্যান- ধারনাকে হত্যা করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া এক ‘নতুন বাংলাদেশের’ ঘোষনা দিয়েছিলেন, যা বস্তুত : পাকিস্থানের অনুসরণ। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তিআওয়ামী লীগ ও সহযোগী দলগুলো ক্ষমতায় গেলে পাকিস্থানীকরণ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা লক্ষণীয়। জেনারেল জিয়ার বিএনপি এবং মিত্রজামাত ক্ষমতায় গেলে আবার পাকিস্থানীকরনের সহিংস প্রয়াস। এই টানা- হ্যাঁচড়ার মধ্যে এ শতকে প্রথম দশকের ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দীর্ঘকাল একনাগাড়ে ক্ষমতাসীন থেকেছে। এসময়ে দর্শন বাস্তবায়নে দলটি কতটা সচেষ্ট ছিল এবং সফল হয়েছে, তা এ নজরে দেখা যেতে পারে। সেই সাথে বঙ্গবন্ধু দর্শন বাস্তবায়নে কোন কোন ক্ষেত্রে অনীহা বা অপারগতা ছিল কিনা, তাও বিবেচ্য। বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বচ্ছতা ও সাফল্য পুরোপুরি না ফিরলেও পাকিস্থানী ধাঁচের ধর্মীয়জাতীয়তাবাদ থেকে বাংলাদেশ মোটামুটি মুক্ত। গণতন্ত্রের অবয়ব রক্ষিত হয়েছে, বিকাশ ঘটেনি। গণতন্ত্র কোন দেশে রাতারাতি বিকশিত হয়। আমাদেরকে ধৈর্য্য এবং স্বচ্ছতার সাথে গণতন্ত্র চর্চা কওে যেতে হবে।
যে ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয় এবং জবাব মেলে না, তা হলো বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন ও নীতিমালা। ২০০৯ পরবর্তীতে রাজনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্যণীয় ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন ও নীতিমালায় প্রত্যাবর্তনের কিছুমাত্র প্রয়াস ছিল না। বরং ক্রোনি- ক্যাপিটালিজমবা উলঙ্গ- পুঁজিবাদের প্রতি ক্রমাগত আসক্ত হয়ে পড়েছে এবং এখনো পড়ছে। ‘একদিকে মুজিব বর্ষ’ পালন করা, অন্য দিকে মুজিবের অর্থনীতির বিপরীতে স্থান গ্রহন করা বেশ রহস্য জনক ঘটনা। পরবর্তীকালে নিরাসক্ত গবেষণা মাধ্যমে এর বিস্তারিত জানা যাবে। তবে আপাতত উপসর্গ- ভিত্তিক কিছু ধারনা প্রকাশ করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে, অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহন ও পরিচালন করতেন ক্ষমতাসীন রাজনীতিক বৃন্দ। তারা এবিষয়ে জাতীয় দশর্নেও বাহিওে যেতেন না। এখানে ব্যক্তি বা গোষ্টি স্বার্থ বিবেচ্য ছিল না। এর বিপরীতে পঁচাত্তর- উত্তরকালে এবং বর্তমানে ও অর্থনীতি নির্ধারন করেছেন ধনী গোষ্টি বা ক্রোনি ক্যপিটালিষ্টবৃন্দ।
এদের কাছে ব্যক্তি ও গোষ্টি স্বার্থই প্রধান। এদের অর্থ উর্পাজনের সূত্র ও প্রশ্নবিদ্ধ। না হলে জাতীয়- আয়ের এক তৃতীয়াংশ কি করে কালোটাকা হয়?
গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতা ফিওে না আসা পর্যন্ত ধনী গোষ্টি হাত থেকে ছুঁটে আসা রানীতিকদেও জন্য সম্ভব হবে না। বরং রাজনীতি ও ক্ষমতা সাদা- কালো উভয়বিধ টাকার আশ্রয়ে- প্রশ্রয়ে লালিত হবে। তাই বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনে প্রত্যাবর্তনে একটি কঠিন রাজনৈতিক আন্দোলন প্রয়োজন। মুজিবের দল হলেই হবে না, মুজিবের সত্যিকার অনুসারী হতে হবে।
0 Comments