শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন হামিদ স্মরনে -
-খোন্দকারইব্রাহিমখালেদ
নব্বইএর দশকে FSRP বাফিনান্সিয়াল সেক্টররির্ফম প্রোগ্রাম চলাকালে হুমায়ুন হামিদ উক্ত প্রোগ্রামে যুক্ত হয়ে সোনালী ব্যাংকে ‘প্রোগ্রাম এডভাইজার ’ হিসেবে কাজ কওে ছিলেন। পুরো প্রোগ্রামটি বিশ্ব ব্যাংকের উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছিল। হুমায়ুন হামিদের দায়িত্ব ছিল, রির্ফম বিষয়ে প্রশিক্ষণ তত্বাবধানকরা, যাতে কওে প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজতর হয়। উল্লেখ্য, প্রকল্পের অধিনে ব্যাংকের সিস্টেম, কার্য পদ্ধতি, পরিচালনা সব কিছুরই সংস্কার সাধন করা হয়।
হুমায়ুন হামিদ একজন মৃদুভাবী, সরলমনা এবং কর্তব্য পরায়ন কর্মকর্তা ছিলেন। সচরাচর তাঁকে রাগান্বিত হতে দেখা যেতনা। সহকর্মীদের সাথে বন্ধু সুলভ আচরন করতেন। ভুল ভ্রান্তি হলে বুঝিয়ে দিতেন, সাহায্য করতেন, কখনো কর্কশ ব্যবহার করতেন না। তিনি ভোজন রসিক ছিলেন। ভালো খাবার নিজে যেমন পছন্দ করতেন, অপরকে ও খাওয়াতে পছন্দ করতেন। তিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাকা কালে ঢাকায় হরতাল হলে প্রবীণ নির্বাহীদের নিয়ে নিজে ও ব্যাংকেরা ত্রিযাপন করতেন। তখন দুপুর ও রাতে বাবুর্চী দিয়ে সুস্বাদু রান্না হত। তিনি প্রবীণ সহকর্মীদের নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেতেন। অবশ্য তিনি অবসওে যাওয়ার পওে ও হরতালের মধ্যে ব্যাংকে খাবার পদ্ধতিটা চালু ছিল। হরতালে কাজ কম থাকতো। হুমায়ুন হামিদ মন উজাড় কওে গল্প করতে পছন্দ করতেন। মনেহত অগ্রণী ব্যাংক একটি পরিবার।
ঐ সময়টা বেশ ঘটনা বহুলছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। ব্যাংকে প্রতারনা ও বেড়ে গিয়েছিল। হুমায়ুন হামিদ ধৈর্য্যরে সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতেন। স্মরন থেকে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। একদিন আমি সহ দু’একজন সহকর্মী বসে আলাপ আলোচনা করছি বাবস্থাপনা পরিচালকের সাথে। এরি মধ্যে একজন দর্শনার্থি ঢুকলেন। গোপনে কিছু বলতে চাইলেন। হুমায়ুন হামিদ আমাদের দেখিয়ে বল্লেন, এরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এদেও সামনেই বলতে পারেন। আগন্তক নিঃসংকোচে বললেন, “ন্যাভাল চিফ আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাকে হয়ত ফোন করেছেন। একটা বিশেষ কাজের জন্য একটা বড় অনুদান দরকার। চিফ সাহেব আমাকে টাকা নিতে পাঠিয়েছেন।” এম.ডি সাহেবের নির্দেশে অপাওে টরন্যাভ্যাল চিফকে টেলিফোনে সংযোগ দিলেন। আগন্তক রীতিমত ক্ষেপে উঠলো। উত্তেজিত কন্ঠে বলতে লাগল ‘ন্যাভাল চিফ তো আগেই ফোনে বলে দিয়েছেন। আবার তাকে ফোন কেন ? ” এদিকে ন্যাভাল চিফ টেলিফোনে জানালেন, তিনি ফোন ও করেন নাই, কাউকে পাঠান ও নাই। আগন্তক তখন ছুটে পালাচ্ছে চিৎকার করতে করতে। করিডোওে তাকে ধওে কিছ ুউত্তম-মধ্যম দিয়ে কর্মচারীরা তাকে রাস্তা ধরিয়ে দিল।
অন্য এক দিনের কথা। এম. ডি সাহেব ইন্টারকমে আমাকে ডাকলেন। গিয়ে দেখি একজন সহকর্মী ও সেখানে আছেন। তাঁকে ও এম.ডি সাহেব ডেকে নিয়েছেন। পাশের চেয়াওে একজন আগন্তক বসা। সুঠাম দেহ, সুন্দর পেশাকে সজ্জিত। তিনি বেশ গর্হিত ভাবে বলছিলেন, ‘জেনারেল এরশাদ সাহেব পাঠিয়েছেন। ৫ কোটি টাকা দিতে বলেছেন। টাকাটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন। ’তিনি যখন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন, তখন আমি উচ্চ স্বরে বলে উঠলাম ‘আপনি কি চাঁদাবাজ? ব্যাংকে চাঁদাবাজি খাটে না। ’তিনি আবারো বল্লেন, ‘রাষ্ট্রপতি এরশাদ তাকে পাঠিয়েছেন। ’হুমায়ুন হামিদ নির্বাক। আমরা দু’তিনজন মিলে আগন্তককে বুঝালাম। ‘টাকা চাইলে দেয়া যায় না। একাউন্ট ওপেন করতে হবে। দরখস্ত করতে হবে। ’হিসাব খোলার ফর্ম, দস্তখত কার্ড হাতে দিয়ে, এসব পূরন কওে কাল নিয়ে আসবেন। কি জন্য টাকা প্রয়োজন, তা ও দরখাস্তে লিখতে হবে। ’তাকে পাহারা দিয়ে লিফটে উঠিয়ে দিয়ে ফিরলাম। তখন এম.ডি সাহেব বল্লেন, “জেনারেল এরশাদ সত্যি সত্যি ফোন কওে ছিলেন এবং নিজেই কথা বলেছেন। ট্রলার ক্রয়ের জন্য লোন দিতে বলেছেন। অগ্রণী ব্যাংকের পাশে তখন শিল্পমন্ত্রণালয়ের কার্যালয়। খোঁজ নিয়ে একটা অর্ডার বের করলাম যেখানে CMLA থাকা কালে জেনারেল এরশাদ নির্দেশ দিয়েছিলেন, “পূনরা দেশ না দেয়া পর্যন্ত, ব্যাংক সমূহ ট্রলার ক্রয়ের জন্য লোন দেবে না।” পরদিন আগন্তক কাগজপত্র আনার পর অর্ডারের কপিতার হাতে দিয়ে বল্লাম, “ এ আদেশ ভঙ্গ করা যাবে না।” আগন্তক রেগে-মেগে আগুন। তাকে জোর করে বের করে দেয়া হলো। হুমায়ুন হামিদ তখন রীতিমত ভীতমÍ্রস্ত। পওে রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবকে ফোন কওে জানানো হলো। ঘটনা এ পর্যন্তই। তবে হুমায়ুন হামিদ সাহেবকে যে রকম বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল, তাতে আরো চিন্তিত হয়ে পড়লাম। অবশ্য আল্লাহর রহমতে ওখানেই শেষ। ঘটনা আর গড়ায় নি।
অপর ঘটনাটি আমাকে নিয়েই ঘটেছিল। আমি তখন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমীতির সভাপতি। সেই সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি সমীতির একটি বড় সেমিনার কওে ছিলাম। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. মোজাফফর আহম্মদ, ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদসহ সেরা অর্থনীতিবিদেরা উপস্থিত ছিলেন। শিল্প-সচিবসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রবৃন্দ এসেছিল। সভাপতিত্ব করেছিলাম আমি। নিজের লেখা একটি নিবন্ধ পাঠ করেছিলাম আমি। নিবন্ধে বিভিন্ন খাতের অবস্থান উল্লেখ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, শিল্পখাত ঐ সময় অনেকটাই স্থবির হয়েছিল। শিল্প সচিব মহোদয় আলোচনায় অংশ নিয়ে আমার নিবন্ধটির ও পরকিছুটা অসৌজন্য মূলক ভাষায় বক্তব্য রাখায় উপস্থিত ছাত্রবৃন্দ দাঁড়িয়ে হৈ চৈ করতে করতে এক পর্যায়ে সামনে এগিয়ে শিল্প সচিবকে সেমিনার কক্ষ থেকে বের করে দেয়। কারন শিল্প সচিব ছাত্রদের ও কটুক্তি করেছিলেন। অবশ্য সেমিনার ভাল ভাবে সমাপ্ত হয়েছিল এবং মিডিয়াতে ভালো কভারেজ পেয়েছিল।
কয়েক দিন পর, শিল্প সচিবের একটি ডি.ও. নোটের উপর ভিত্তি করে প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমাকে ও .এস .ডি করার নির্দেশ দেন। অর্থমন্ত্রী বা অর্থসচিব কিছুই জানতেন না। অর্থসচিব বাধ্য হলেন অর্ডার ইস্যু করতে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন হামিদ আমাকে ডেকে অর্ডারটি দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি অর্থসচিবকে কিছু জিজ্ঞেস কওে ছিলেন কিনা অথবা কোন মতামত দিয়েছেন কিনা। জবাবে এম. ডি সাহেব ‘না’ বল্লেন। আমার মনে হয়েছিল, এম .ডি মহোদয় আমার পক্ষ নিয়ে কিছু বলেন নি, বরং সরকারি সিদ্ধান্তের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ছিলেন। আমি এক
টু ব্যথিত হয়ে ছিলাম। অবশ্য তাঁর কিছ ুকরার ও ছিল না। নিজের নির্দোষ কর্মকর্তার পক্ষ অবলম্বনের সাহস তার ছিলনা। আমার অবশ্য কোন অসুবিধা হয় নাই। আমি ডেপুটেশনে নবগঠিত পল্লী সন্বায়ক ফাউন্ডেশনে যোগ দিয়েছিলাম এবং কাজ করেছিলাম। জনাব এম. সাইদুজ্জামান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং আমাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। আমার বিরূদ্ধে কোন অভিযোগই ধোপে টেকে নাই। এরশাদ সাহেব গণ আন্দোলনে ধপাস পতিত হলে আমি সসম্মানে অগ্রণী ব্যাংকে প্রত্যাবর্তন কওে ছিলাম এবং তিনমাসের মধ্যে পদোন্নতি পেয়ে ম্যনেজিং ডিরেক্টও হয়ে ছিলাম। জনাব হুমায়ুন হামিদ আমার পদোন্নতিতে খুশী হয়েছিলেন।
এমনি বিভিন্ন ঘটনায় জনাব হুমায়ুন হামিদকে আমি দেখেছিলাম একজন সজ্জন ও সহৃদয় ব্যক্তি হিসাবে। সেইসাথে নেতৃত্বে কিছুটা নমনিয়তা ও তার মধ্যে লক্ষ্য করেছিলাম। তিনি এখন পরকালে। শান্তিতে তাঁর অবস্থান হোক।
0 Comments