-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
জীবন মৃত্যুর চক্রায়নে মানুষ-মাত্রই আগমনের পর প্রস্থান করে। কিছু কিছু মানুষ প্রস্থানের পরেও মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করেন, মানুষকে প্রভাবিত করতে থাকেন, মানবিকতার আলোকচ্ছটায় রেখে যাওয়া সমমনাদের আলোকিত করতে থাকেন। অজয় রায় ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। তাঁর বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। অজয় রায় নিজে ছিলেন একাধারে মেধাবি, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক উৎকর্ষতায় সমুজ্বল। শিক্ষা জীবনে বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক মেধার স্বাক্ষর বহন করে। লোভ-প্রলোভনের উর্দ্ধে উঠে, বিত্ত অর্জনের প্রতিযোগিতা থেকে নিবৃত্ত থেকে তাঁর সমস্ত মেধা-সামর্থকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করে তিনি নৈতিক উৎকর্ষতায় ভাস্বর হয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিত্ত-ক্ষমতা অর্জন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। হৃদয়বৃত্তির কারনে নিজে ত্যাগ স্বীকার করে অপরের ভাগ্য উন্নয়নে অবদান রেখেছেন, এমন স্বল্প সংখ্যক মানুষের কারনেই সমাজ টিকে থাকে, অগ্রসর হয়, সহমর্মী হয়ে ওঠে। মেধা-মননের সম্মিলনে অর্থাৎ বৃদ্ধিবৃত্তিক মেধা আর হৃদয়বৃত্তিক নৈতিকতার মনন কোন মানুষের মধ্যে একত্রিত হলে, সে মানুষটি হয়ে ওঠে সমাজের পরশমনি। এমন মানুষের কর্মযজ্ঞে সমাজের কুসংস্কার-কুপমন্ডকতা দূর হয়, মানবিতার বিকাশ ঘটে, হিংসা-বিদ্বেষ হ্রাস পেয়ে সমাজে ভালবাসা সৃস্টি হয়, পৃথিবী অধিকতর বাসোপযোগী হয়ে ওঠে। মহৎ ব্যক্তিদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমেই সমাজ শান্তি-ভালোবাসার সন্ধান পায়। এঁদের উদ্দেশ্য করেই ¯্রষ্টা বলেছেন, ‘আমি মানুষকে আমার অবয়বে সৃস্টি করেছি। মানুষকে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ মানুষের কল্যানে যাঁরা নিজেকে বিলিন করে দেয়, বিত্ত-প্রতিপত্তি অর্জনের সক্ষমতা থাকা সত্বেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে স্বীয় মেধা-মনন দিয়ে অপরের কল্যান বিধান করে, তাঁরাই মানবজাতির শ্রেষ্ঠদের অন্যতম। এঁদের ধর্ম হলো মানবধর্ম। মানুষের কল্যানে এঁদের জন্ম। মানুষের কল্যানেই এঁদের জীবন।
অজয় রায় ছিলেন সমাজচিন্তক, সমাজকর্মী এবং সামাজিক নেতা। তাঁর সমাজ ছিল তাঁর দেশের মানুষ, যার অনুপ্রেরণা ছিল দেশের মাটি। মাটি আর মানুষের বন্ধন থেকে তিনি কখনোই মুক্ত হতে পারেননি। বাংলাদেশের মাটির সুগন্ধে তিনি ছিলেন বিমোহিত। বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে তিনি ছিলেন সদানিয়োজিত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়েছিল ধর্ম-ভিত্তিতে। হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান বা ভারত আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান। ভারত থেকে যেমন লক্ষ লক্ষ মুসলমান পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন, তেমনি পাকিস্তান থেকেও লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। পূর্ববাংলার উচ্চবর্ণ, উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের অধিকাংশ হিন্দু দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মাটির টানে নিজ দেশেই রয়ে গেলেন অজয় রায়। প্রতিকুল পরিস্থিতি জেনেও বেছে নিয়েছিলেন মাটি ও মানুষকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও হিন্দুস্তানে যান নি। কারণ তিনি মানব ধর্মে বিশ্বাস করতেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- এই ছিল তার বিশ্বাস।
অজন রায়ের মাটির টান আরেকবার প্রমাণিত হল তাঁর মুত্যুতে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত: মৃত্যুর পর অগ্নিতে শুদ্ধ হন। অজয় রায় মৃত্যুর আগে ইচ্ছা বক্ত্য করলেন নিজ দেশে নিজ গ্রামে জন্মভূমির পূন্যভূমিতে সমাধিস্থ হতে। অন্তিম ইচ্ছানুসারে তাঁকে তাঁর প্রিয় মাটিতে সমাধিস্থ করা হল তাঁর প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে। এই ঘটনা দুটি প্রমাণ করে, অজয় রায় সংকীর্ণতা থেকে কত উর্ধে ছিলেন। মাটির টান তাঁর কাছে কত নিবিড় ছিল, মানুষের প্রতি ভালোবাসা কত হৃদয়গ্রাহী ছিল।
অজয় রায়ের সাথে আমার পরিচিতি দীর্ঘদিনের। তিনি ছিলেন রাজনীতিক। আমি ব্যাংকিং পেশার মানুষ। তিনি আমার ব্যাংকের গ্রাহকও ছিলেন না। আমিও কখনো রাজনীতি করি নাই। তাঁর কমুনিষ্ট পার্টি সম্পর্কে আমার তেমন কোন আকর্ষণ ছিল না, উৎসুক্যও ছিল না। প্রথম থেকেই তার সঙ্গে আড্ডার আসরে এগুলো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং তাঁর জীবনবোধ, উদারতা, হৃদয়ের উষ্ণতা, মাটি আর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁকে আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। কোন নির্দিষ্ট আদর্শ বা মতামতের মানুষকে তিনি পছন্দ করতেন, তেমনটা নয়। যে যেমন তাকে তেমনটা মেনেই গ্রহণ করতেন। ‘মতাদর্শ’ যার যার, আড্ডাটা সবার’। কখনোই কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। ঔদার্য্য তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে সবার কাছে বাড়িয়ে তুলতো।
তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বেড়ে যায় পড়শী হিসেবে। একসময়ে দু’জনেই ওয়ারীতে ছিলাম। তিনি র্যাংকিন ষ্ট্রিটে। আমি পরবর্তী সমান্তরাল রাস্তা লারমিনি ষ্ট্রিটে। সময়টা আশির দশক। প্রথমে সামরিক আইন, তারপর একনায়কতন্ত্র। সবশেষে তুমুল গণআন্দোলন এবং স্বৈরতন্ত্রের পতন। পুরোসময়টাতেই আমাদের আড্ডার কেন্দ্র ছিল অজয়দার বাসা। অন্য সব আড্ডার মত রাজা-উজির মারা তো চলতই। তবে আমাদের আড্ডার সবচেয়ে উপভোগ্য দিক ছিল মস্তিস্ক সঞ্চালনমূলক বিশ্লেষনাত্বক আলোচনা যাকে ইংরেজীতে বলা হয় ব্রেইন ষ্টর্মিং (Brain storming )| বাস্তবমুখী চুলচেরা বিশ্লেষনের লক্ষ্য ছিল প্রকৃত পরিস্থিতি উদঘাটন করা ও অনুধাবন করা, যার ভিত্তিতে ভবিষ্যত সম্ভাব্য পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা এবং তদনুযায়ী কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা। অবশ্য কর্মসূচী থাকতো নাগরিক সমাজের উপযোগী। সেমিনার, কর্মশালা, গোলটেবিল- এসব জাতীয় কর্মসূচী পরিচালিত হত। ওয়ারী থাকাকালিন সময়ে অজয়দাকে মাঝে মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে দেখতাম। কম্যুনিষ্ট পার্টির প্রবীণ নেতা হিসাবে তিনি অভ্যস্তও ছিলেন। সাধারণত বিকেলের দিকে ¯œান করে এককাপ গরম চা খেয়ে তৃপ্তির সাথে বেরিয়ে পড়তেন ঘর থেকে বিষয়টি আমরা বুঝে ফেলেছিলাম। কখনো আমরা উপস্থিত থাকলে রসিকতা করে জিজ্ঞেস করতাম, ‘শ্বশুরবাড়ী যাচ্ছেন নাকি? তিনি সহাস্যে জবাব দিতেন, ‘হ্যাঁ সেজন্যেই তো সেজেগুজে নিলাম।’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণের পর আমি ধানমন্ডি একটা ফ্লাটে চলে এলাম। বেশ কিছুকাল অজয়দার সাথে দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছিল না। হঠাৎ একদিন বাসায় এসে হাজির। প্রাণোচ্ছ্বল হাসি দিয়ে কৌতুকোচ্ছলে বল্লেন, ‘না বলে ওয়ারী থেকে চলে এসেছেন। ভেবেছিলেন পালিয়ে থাকবেন। তাই খুঁজে বের করে হাজির হলাম।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আপনি কি ওয়ারীতেই আছেন?’ উচ্ছ্বাস ভরে জবাব দিলেন, ‘আরে না। আমিও ধানম-ি চলে এসেছি। এই তো আপনার পাশের রাস্তায়। সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের ঠিক সামনে। বাড়িটি নতুন হয়েছে। মাত্র উঠেছি।’ সোৎসাহে বল্লাম, ‘তাহলে তো আড্ডা আবার জমবে।’ হ্যাঁ, আড্ডা আবার জমেছিল। ব্যক্তিগত আড্ডা। সামাজিক আড্ডা। রাজনৈতিক আড্ডা। সবরকম আড্ডাই হতো। আজ বেশী করে মনে পড়ছে জামাত-বি এন পি জোট আমালের শেষ দিকের গণআন্দোলন এবং তৎপরবর্তী জেনারেল মঈন ইউ আহমদের সামরিক পৃষ্ঠপোষকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের সময়ে অজয়দার বাসায় গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক আড্ডার স্মৃতি। কাছেই আমার বাসা এবং আড্ডাগুলো বেশ মজাদার হতো- এই দু’কারণেই যেতাম। বামধারার বিভিন্ন দলের রাজনীতিকরাই বেশী সংখ্যায় উপস্থিত থাকতেন। রাজনীতির গ-ির বাইরে আমার মত উৎসাহী নাগরিকদের উপস্থিতি কমই ছিল। কোন কোন দিন আমি একাই। আমার উপস্থিতিতে রাজনৈতিক আলোচনায় আড়ষ্ঠতার ভাব লক্ষ্য করলে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আস্তে উঠে পড়তাম। যাতে তারা স্বস্তি বোধ করেন। রাজনৈতিক আড্ডার অংশগ্রহণকারীরা সমমনা ছিলেন। তাঁরা সমসাময়িক পরিস্থিতি তুলে ধরতেন, বিশ্লেষন করতেন, অজানা তথ্য উপস্থাপন করতেন, ঘটনার পেছনের সাম্ভাব্য সূত্রগুলো বুঝতে চেষ্টা করতেন, আগামীর ঘটনাপ্রবাহ অনুধাবন করার চেষ্টা করতেন এবং তাঁদের নিজ নিজ দলের ভূমিকা বা করনীয় বিষয়ে মতবিনিময় করতেন। আড্ডার অঘোষিত সমন্বয়ক ছিলেন অজয় রায়। এ ধরনের রাজনৈতিক আড্ডা শুধুমাত্র জাতীয় সংকটকালেই সংঘটিত হতো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর ঐ মুখগুলোর দর্শন কমই মিলতো। আমাদের সাধারণ আড্ডার আলোচনার বিষয় ছিল পাঁচমিশেলি। রাজনীতির বিষয়ও থাকতো। তবে তা ছিল ¯্রফে পর্যালোচনামূলক। কর্মসূচীমূলকও নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলকও নয়। তবে উভয় প্রকার আড্ডার অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন পরিচয়ের হলেও সব আড্ডাতেই অভিন্ন উপাদান থাকতো বড় বড় কাপে গরম গরম চা।
বয়স বেড়ে যাবার পর থেকে অজয়দার সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকা- মোটামুটি গোলটেবিল-সেমিনারেই সীমাবদ্ধ থাকতো। সমাজের চিন্তাশীল প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গই অংশগ্রহণ করতেন। সভাপতিত্ব করতেন অজয়দা নিজেই। বক্তাদের বক্তব্যের বৈশিষ্ট এবং অজয়দার বিশেষ পরিচিতির কারণে প্রতিটি বৈঠকের খবর প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকসমুহে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হতো। আলোচনাচক্রে আপ্যায়নের আইটেম থাকতো বড় সিংগাড়া আর চা। অধিকাংশ আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হত সেগুনবাগিচাস্থ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে।
প্রতিবেশী হবার কারণে তিনি মাঝে মাঝেই চলে আসতেন আমার বাসায়। কখনো একা। আবার কখনো কাউকে সঙ্গে নিয়ে। সন্ধ্যার পরেই আসতেন অধিকাংশ সময়। তবে সকালেও এসেছেন কখনো। লম্বা সময় আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। চা-নাশতা তৃপ্তির সাথে উপভোগ করতেন। সর্বশেষ এসেছিলেন মৃত্যু-পূর্ব অসুস্থতার অল্প আগে। গাড়ী থেকে কেউ একজন তাঁকে ধরে ধরে নিয়ে এসেছিল আমার এপার্টমেন্টে। এদিনই প্রথম লক্ষ্য করলাম চা-নাশতার প্রতি তাঁর অনিহা। চা-কাপে এক চুমুক দিয়ে রেখে দিলেন। আর কিছু মুখে দিলেন না। মনে হচ্ছিল খুব ক্লান্ত। শুধু বল্লেন, দেখতে এসেছি কেমন আছেন। আমি দু’চার কথা বল্লাম। তিনি মিনিট পাঁচেক চুপচাপ বসে থেকে উঠতে উঠতে বল্লেন, ‘ভালো থাকবেন’। আমি সাথে গিয়ে তাঁকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে একটু দাঁড়ালাম। গাড়ী চলা শুরু করলো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ালেন। আমিও হাত দেখালাম। তারপর চলে এলাম।
দীর্ঘ জীবনে অমসৃন পথে চলেছেন, যদিও মসৃন পথে চলার সুযোগ ছিল। মেধাবী ছিলেন। মেধাকে কাজে লাগিয়েছেন মানুষের কল্যানে। অর্জন করতে পারতেন অর্থসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতার মঞ্চ। ওসব তাঁকে প্রভাবিত করতে পারেনি। লোভ, পদ-পদবী, সহায় সম্পত্তি, -কোন কিছুই তাঁকে জয় করতে পারেনি। তাই আজীবন অজেয় থেকেছেন অজয় রায়।
0 Comments