Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

একুশে ফেব্রুয়ারিঃ সেকাল ও একাল


                                                      খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে এটি একটি তারিখ মাত্র ছিল, ক্যালেন্ডারের অন্যান্য তারিখের মতই। কারো জন্মদিন। কারো বিবাহবার্ষিকী। কখনো বা ছুটির দিন বা অন্য কোন কারণে ক্যালেন্ডারে চিহ্নিত। ১৯৫২ সালে এসে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আর তারিখ রইলো না।  সবকিছু ছাড়িয়ে হয়ে উঠলো এক মূর্ত প্রতীক। অনেকজন অনেকভাবে এর প্রতিকী অর্থ প্রকাশ করেছেন। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে মায়ের ভাষা। একুশ মানে রক্তবীজ। একুশ মানে ভালোবাসা। একুশ মানে স্বাধীনতা।

একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তবীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালী জাতির বোধিবৃক্ষ। ঘুমন্ত বাঙালী জেগে উঠেছিল। আত্ম পরিচয় খুঁজে পেয়েছিল। মোগল-পাঠান-ইংরেজ আর পাকিস্তানী শাসনের শোষন ভাঙ্গার প্রত্যয়ে দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছিল। বায়ান্নর পরিনতিই একাত্তর। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত ‘একুশে’ পালন করতো বাংলার গণমানুষ। সরকার কখনো বাধাদানকারী, কখনো নিরব দর্শক। কোন আইন পাশ হয়নি, সরকারি নির্দেশ জারী হয়নি, বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়নি। বোধিবৃক্ষের অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে বাংলার গ্রামে গঞ্জে রাতারাতি গড়ে উঠেছিল অসংখ্য শহীদ মিনার। একুশ মানে স্বাধীনতা। আর একুশের প্রতীক হলো শহীদ মিনার। তাই একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালোরাতে হানাদার বাহিনী শহীদ মিনার আক্রমন করেছিল। নিস্প্রাণ ইট-সুরকিতে তৈরী শহীদ মিনারে প্রতিফলিত হয়েছিল বাঙালী জাতির প্রাণ।

১৯৬২ সালের একটি ছোট্ট ঘটনা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শিক্ষা আন্দোলন চলছিল। সে আন্দোলনেরও শক্তি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ছাত্ররা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে অনুরোধ করেছিল, একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই যেন সকল সাইনবোর্ড বাংলায় রূপান্তর করা হয়। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র ছিল না, লাঠি ছিল না। আবেদনের ভাষায় হুমকি ছিল না। ভালোবাসা ছিল। ম্যাজিক ঘটে গেল। অল্প কয়েকটি দোকান ছাড়া সব দোকানপাটে বাংলা সাইনবোর্ড লাগানো হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্ররা নিজেদের পয়সায় আলকাতরা কিনে ভিন্ন ভাষায় লেখা সাইনবোর্ডগুলোতে আলকাতরা মাখিয়ে দিল। কাউকে ভয়ভীতি দেখানো হয়নি।
আজ দেশে পাকিস্তানীরা নাই। শাসনেও বাঙালী। শোষনেও বাঙালী। তোষনেও বাঙালী। আমি কিন্তু আজ আর সেদিনের ‘একুশ’কে প্রত্যক্ষ করছি না। ঢাকার রাস্তার দুপাশের সাইনবোর্ডগুলো অধিকাংশই বিজাতীয় ভাষায়। এমন কি বাংলা নামটিও ইংরেজি অক্ষরে লেখা। কথাবার্তায় ইংরেজির মিশেল না দিলে তো অভিজাত হওয়া যায় না। সংগ্রামের বাঙালী কি বিজয়ের শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে? একুশের বোধিবৃক্ষ কি মরে গেছে?

অনেকেই বলে থাকেন, বিশ্বায়নের কালোছায়ায় বাঙালীরা নাকি স্বকিয়তা হারিয়ে ফেলছে। জাপানী এবং কোরিয়ানরা আগে ইংরেজি শিখত না। এখন ব্যবসার জন্য অনেকে শেখে। কিন্তু নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তায় ইংরেজি বলে না। এমন কি রেস্তোরার গ্রাহকদের সাথেও ইংরেজি বলে না। জেনেও না জানার ভান করে। তারা জাতীয়তা সংহত করেছে। আমরা অর্জনের পর বিসর্জন দিচ্ছি। কিন্তু কেন?

শহীদ মিনারকে বলেছিলাম বায়ান্নর বাংলাভাষার প্রতীক। একাত্তরে এসে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ তথা বাঙালী জাতির হিমালয় সম প্রতীক। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে বাঙালী জাতিকে হত্যা করা হয়েছিল। বাঙালীত্বকে হত্যা করা হয়েছিল। কিছু সংখ্যক  নাদান বানর প্রকৃতির বাঙালী এখন অযাচিত ভুল ইংরেজি বলে ‘জাতে’ উঠতে চায়। ডালভাত খাবার ভাঙাচোরা রেস্তোরায় ইংরেজিতে ‘ফাইভ স্টার হোটেল’ সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে তৃপ্তি বোধ করে। গ্রাহকরা সাইনবোর্ডটি পড়তেও পারে না। বরং ইংরেজি লেখায় একপাশে একটি মুরগী ও অন্যপাশে একটি খাশী বা গরু আঁকা দেখে বুঝতে পারে এটা হোটেল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি?

মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের দেশ বলে গর্ব করা হলেও চিত্তের সংকীর্নতা থেকে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। বিত্ত কখনো চিত্তে অবস্থান করে না। চিত্তে থাকে ভালোবাসা। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। বাঙালীর চিত্তে অবস্থান গ্রহণ করে চিত্তকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে চিত্ত হত্যা করে আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি তথা বিত্তের পেছনে কুকুরের মত ঘুরছি। বিত্ত আহরণে দোষ নাই। কিন্তু বিত্ত নিয়ে অহংকার চিত্তের বোধিবৃক্ষকে হত্যা করে ফেলেছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ব করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। বায়ান্নর আত্মউপলদ্ধির বৃক্ষকে জলসিঞ্চন করতে হবে। একাত্তরের আত্ম-প্রত্যয় এবং অর্জনকে আবার হৃদয়ে স্থাপন করতে হবে। আমার মতো বায়ান্নদর্শীদের এটাই আশাহত বিলাপ।        


Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে