Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

আদরের কন্যা থেকে জননেত্রী


                                                      ॥ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ॥

পারিবারিক জীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীল। বাঙালি কৃষ্টিতে গড়ে ওঠা পরিবারটিতে বন্ধন ছিল সংহত। বাবা-মার প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা গড়ে উঠেছিলেন একাধারে আদুরে কন্যা এবং দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে। বাবা একযুগের বেশি জেলেই কাটিয়েছেন। সংগঠনের কাজে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। সংসার দেখাশোনায় মায়ের সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। দলের কর্মীবাহিনীও সম্প্রসারিত পরিবারে ঠাঁই করে নিয়েছিল। আজ পনেরো কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের যে বিরাট দায়িত্ব তিনি বহন করছেন, তার প্রথম পাঠ বুঝি কৈশোরের পরিবেশ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন।

সাংসারিক জীবনে স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ রাজনীতিসচেতন ছিলেন, কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ফজলুল হক হলের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ষাটের দশকের প্রথম দিকে। ছাত্রলীগ থেকে তার মনোনয়ন ছিল মেধাবী ছাত্র হিসেবে। রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার জন্য ততটা নয়। রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম তার মধ্যে কম থাকলেও তিনি ছিলেন প্রগতিবাদী, উদার, বিজ্ঞানমনস্ক এবং অধিকার-সচেতন।
একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। শেখ হাসিনা মায়ের সঙ্গে বন্দি জীবনযাপন করতে থাকলেন।

দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন মাতৃভূমিতে। শেখ হাসিনা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে ঘর-সংসার করেছেন। এতে মনে হয় রাজনীতিতে প্রবেশের ইচ্ছাও সম্ভবত তার ছিল না।
১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে মোশতাক-জিয়ার ছত্রছায়ায় কয়েকজন বর্বর নরপশু নারকীয় হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি শিশুপুত্র রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। এমনি কঠিন দুঃসময়ে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেন বিদেশে থাকার কারণে। আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের নেতাদের হত্যার পর সামরিক জান্তা ‘পোষ মানা’ আওয়ামী লীগ বানাতে চেয়েছিল। কে পারবে সে সংকট থেকে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করতে? এমন এক সময়ে যিনি সুদিনে রাজনীতিতে আসেননি, যিনি পিতার হাত ধরে দলে অভিষিক্ত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেননি, তিনিই রাজনীতির কারবালা প্রান্তরে এগিয়ে এলেন। দলের প্রবীণদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন, রাজনীতিতে নবাগত, বয়সে তরুণ এবং অনভিজ্ঞ শেখ হাসিনা তাদের কথামতো চলবেন। তারা হিসাবে ভুল করেছিলেন। শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে কর্মীবাহিনীর আস্থা অর্জন করলেন। জনতার হৃদয় জয় করলেন। বঙ্গবন্ধুর আদরের কন্যা হয়ে উঠলেন জননেত্রী।

বঙ্গবন্ধু যেমন সারাজীবন কঠিন উজান ঠেলেছেন, শেখ হাসিনাকেও তেমনি উজান ঠেলে একটু একটু করে অগ্রসর হতে হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছিল শেখ হাসিনার জন্য। কোটালীপাড়ায় তার জনসভায় পুঁতে রাখা হলো বিশাল আকৃতির বোমা। কুষ্টিয়ায় বোমা হামলা হলো। সারাদেশে যেন বোমার খই ফুটতে লাগল। টার্গেট প্রগতিশীল শক্তি। টার্গেট হাসিনা।

নতুন শতকের প্রথমদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তি জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলো। দেশে যেন কেয়ামত নেমে এলো। একদিনে ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটল। সজ্জন অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া বোমার আঘাতে প্রাণ হারালেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন। জেলায় জেলায় জজ সাহেবরা বোমাতঙ্কে ভুগতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রক্তবীজ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। এ যেন অসহ্য! দলটির ওপর দ্বিতীয়বারের মতো মরণ আঘাত হানল সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রকারীরা। এবার আর বোমা নয়। রণাঙ্গনে ব্যবহৃত গ্রেনেড! আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেডের বৃষ্টি ঝরল। গ্রেনেডের বিকট শব্দে শেখ হাসিনার শ্রবনেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রাণে বেঁচে গেলেন তিনি। আবারও প্রমাণ হলো, রাখে আল্লাহ মারে কে? শেখ হাসিনা বিপদের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন। বিপদ মাথায় করেই পথ চলছেন। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে তিনি হয়তো কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে উঠবেন, ‘কঠিনেরে ভালবাসিলাম’।

পিতার সঙ্গে কন্যার অমিল হয়তো রয়েছে। শেখ হাসিনা বজ্রকণ্ঠের অধিকারী নন। বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় সাংগঠনিক সক্ষমতাও তার নেই। জাদুর পরশে ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার বিরল ক্ষমতাও তার নেই। তবু বঙ্গবন্ধুর কিছু দুর্লভ বৈশিষ্ট্য শেখ হাসিনার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হতে দেখা যায়। শেখ হাসিনা পিতার মতো অসীম দুর্বিনীত সাহসী। বোমা, গ্রেনেড আর মৃত্যুর অট্টহাসির মুখে শেখ হাসিনার ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, ধৈর্য এবং শান্ত-সৌম্য চাহনি বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাঁর অনাবিল দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি অবিচল আস্থার মাঝে ফুটে ওঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি। তাই শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন জননেত্রী, গণমানুষের নেতা। যিনি সহজ সময়ে রাজনীতিতে এলেন না, এলেন কঠিনতম মুহূর্তে। তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটি? নির্মোহ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হবে, তিনি নির্মম আঘাতের সমুচিত জবাব দিয়েছেন, কিন্তু প্রত্যাঘাত করেননি। রাজনীতিতে প্রবেশের পর ক্ষমতারোহণ করতে সময় লেগেছে অনেক। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় পিতৃহত্যার বিষয়টি জটিল ও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিনি সহজ পন্থায় প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। সভ্য জগতের হাতিয়ার বিচার প্রক্রিয়াতেই তিনি বিশ্বাস রেখেছেন। অসভ্য ঘাতকপক্ষ কতখানি হিংসাপ্রবণ এবং আঘাতকামী ছিল, তা বোঝা যায় বিচার প্রক্রিয়ায় দায়িত্ব পালনকারীদের ওপর আঘাত হানার ঘটনা অবলোকন করে। মামলার সাক্ষীদের হেনস্তা করা হয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রথম রায় প্রদানকারী জেলা জজ গোলাম রসুলের জীবনকে বিষাক্ত করে তোলা হয়েছিল। ক্রমাগত এবং ভয়াবহ মাত্রায় ভীতি প্রদর্শনের ফলে তার দুই কন্যা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। শেখ হাসিনা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো না। বিএনপি আমলে বিচার প্রক্রিয়া ঝুলে রইল। তার আবার ক্ষমতায় আসার পর রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন সম্ভব হলো। লক্ষ্যে অবিচল, অর্জনে অসীম ধৈর্য। ২১ আগস্ট এত মানুষ হত্যা, কিবরিয়া হত্যা এবং হিংসার লেলিহান শিখায় শান্তিকামী মানুষের আত্মাহুতি। আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ কি পারত না বিপক্ষ শক্তির কিছু লোককে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে? শেখ হাসিনা হত্যা দিয়ে হত্যার প্রতিশোধ নেননি। কারণ সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস দমন করা যায় না। শেখ হাসিনা সভ্য জগতের কঠিন প্রক্রিয়াতেই এগোলেন। ‘জজ মিয়া’ নাটকের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বিচারের পথেই অগ্রসর হলেন।

শেখ হাসিনার সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য সম্ভবত বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি সংবিধানে পুনঃসংযোজন। মূলনীতি বিধ্বস্ত করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু, তার স্বজন-সহকর্মীসহ শত শত মানুষকে হত্যা করে এবং দেশে সন্ত্রাসের বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়ে। অথচ মূলনীতি পুনরুদ্ধার করা হলো সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ায়। ভীতির বিভীষিকা সৃষ্টি করে নয়। সভ্য আইনি প্রক্রিয়ায় চার মূলনীতি সংবিধানে সংযোজন কর্মে কর্তব্যরত অনেক দেশপ্রেমিক সুধীজনের বিরাট অবদান রয়েছে। এ অবদান হিংসার বিরুদ্ধে যুক্তির অবদান। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির অবদান। পশুত্বের বিরুদ্ধে মানবতার অবদান। পশ্চাদগামিতার বিরুদ্ধে প্রগতির অবদান। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সভ্যতা বিনির্মাণে অবদান রাখা অনেক মানুষের বিরাট মিছিলে সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনার সাহসিকতা, ধৈয্য ও বিচক্ষণতার প্রমান পাওয়া যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে। এটি একটি অসাধ্য সাধান। তিনি হত্যার প্রতিশোধ নেননি। বরং জঘন্য অপরাধের বিচার করেছেন। এটি আইনের দাবী।

শেখ হাসিনার আরেকটি সাহসিকতার সিদ্ধান্ত ছিল পদ্মা সেতু নির্মান। বিশ্বব্যাংকের প্রতারণার পর, তিনি মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে হাত দিলেন সেতু নির্মানে। সেতু এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। জাতি আত্মনির্ভরতার অহংকারে বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতির উপযুক্ত নেত্রী শেখ হাসিনা।

সবশেষে জীবন সায়াহ্নে শেরেবাংলার একটি উপলব্ধি স্মরণ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবন সংগ্রামে বিপর্যয় এবং সাফল্যসমূহের বিশ্লেষণ যখন করি, তখন উপলব্ধি করি, নিয়তিই আমাকে পরিচালিত করেছে।’

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে