Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

‘সত্য কথা বলব, সত্য পথে চলব’


                                                    -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

শিরোনামের কথাগুলো ব্রতচারীদের একটি শপথবাক্য। শপথবাক্যটি মুখে উচ্চারণ করে, হৃদয়ে এর মর্ম ধারণ করে, ব্রতচারী আজীবন সত্যের সাধনায় পথ চলতে চায়। এটি একটি জীবনদর্শন। আলো-আঁধার, সত্য-মিথ্যা, পাপ-পূন্য, বিবেক-রিপু এমন অনেক পরস্পর বিরোধী দ্বৈতধারায় প্রবাহিত মানবজীবন। ব্রতচারীর ব্রত হলো আঁধার এড়িয়ে আলোর পথে চলা, মিথ্যাকে দলিয়ে সত্যকে ধারণ করা, পাপকে বর্জন করে পূন্য অর্জন করা, রিপুকে দমন করে বিবেক প্রস্কুটিত করা। কবির ভাষায় ব্রত হল ‘মানুষ হইতে হবে, মানুষ যখন’।

ব্রতচারী একটি কর্মসূচী মাত্র নয়। ব্রতচারী একটি আন্দোলন। সত্যকে লালন না করলে, সত্য স্থাপিত হয় না। মিথ্যাকে আঘাত না করলে মিথ্যা অপসৃত হয় না। সত্য ধারণ করতে হলে প্রয়োজন দৃঢ় অঙ্গিকার, অনবরত চর্চা, মিথ্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় সংকল্প ও কঠিন সংগ্রাম। এই সংগ্রামটাই একটি আন্দোলন। ব্রতচারী আন্দোলন বিশ্বজনীন হলেও এর জন্ম বাংলাদেশে, প্রতিষ্ঠাতা একজন বাঙালী।

ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ গুরুসদয় দত্ত। এই ক্ষনজন্মা পুরুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮২ খৃষ্টাব্দের ১০ মে সিলেটের বীরশ্রী গ্রামে। পরলোক গমন করেছিলেন ১৯৪১ খৃষ্টাব্দের ২৫ জুন। নাতিদীর্ঘ ৫৯ বছর জীবনকালে গুরুসদয় দত্ত একজন আই.সি.এস ( ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ) অফিসার হিসাবে বৃটিশ সরকারের সর্বোচ্চ ক্যাডারে চাকুরী করেছেন। ইংরেজদের সাথে এবং ইংরেজদের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে ক্ষমতাবলয়ে অবস্থান করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানুষের স্বার্থে। ভারতীয়রা আই.সি.এস. হলে চলনে বলনে মন-মানসে ইংরেজ হয়ে উঠতেন। কিন্তু গুরুসদয় দত্ত যেন চাকুরী জীবনে আরও বেশী বাঙালী হয়ে উঠলেন। চিন্তায় চেতনায় তিনি কখনো রাজকীয় হন নি। ছিলেন সাধারণ বাঙালী। এটাই তার ব্যক্তিত্বের একটি বিশেষ দিক।
   
কয়েক বছর আগে বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (বিবিসি) একটি মতামত যাচাই সমীক্ষায় সর্বাধিক ভোট পেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর পরেই স্থান পেয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরু ১৯৪১ সালে মৃত্যুর অনেক আগে ক্ষেদ সহকারে লিখেছিলেন,
সাত কোটি সন্তানেরে  হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালী ধরে, মানুষ করনি।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারী স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রথম পদার্পন করে রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমাবেশে আবেগ ভরে বঙ্গবন্ধু সদর্পে বলেছিলেন, ‘কবিগুরু আপনার কথা ভুল প্রমানিত হয়েছে। আপনি দেখে যান, বাঙালী মানুষ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে।’ বৃটিশ শাসনামলে প্রশাসকের আসনে বসে গর্বভরে বাঙালী হবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় গুরুসদয় দত্তের মাঝে। ১৯৩২ সালে ‘ ব্রতচারী সোসাইটি’ গঠন করার পর এই সংগঠনে সদস্য হতে ইচ্ছুকদের তিনটি প্রত্যয় বাক্য উচ্চারণের বিধান করেন তিনি। বাক্য তিনটি হলঃ
আমি বাংলাকে ভালোবাসি।
আমি বাংলার সেবা করব।
আমি বাংলার ব্রতচারী হব।

‘ব্রতচারী’ নাম এবং ব্রতচারী সংগঠন সম্বন্ধে গুরুসদয় দত্ত লিখেছিলেন, “জীবনকে স্বভূমির ছন্দে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়াও তাকে একটা পবিত্র ব্রত গ্রহণ করে কয়েকটি সুচিন্তিত, সুসংবদ্ধ ও সুগভীর আদর্শের সাধনার ভিতর দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। এই উপলদ্ধির ফলেই আমার মনে ‘ব্রতচারী’ নামের স্বতঃউদ্ভব হয় এবং ব্রতচারীর আদর্শমূলক তেরটি ‘পণ’ এর পরিকল্পনার জন্ম হয়। ঐ শিক্ষাশিবিরে সমবেত অনুশীলন প্রার্থী ও শিক্ষকদের কাছে এই পরিকল্পনার উল্লেখ ও বর্ণনা করি, এবং একদিকে বাংলার জাতীয় স্বছন্দ ও আদর্শবাহী নৃত্য ও গীতের অনুশীলন এবং অপর দিকে আত্মার কর্তব্যের ব্রত পালনের সাহায্যের জন্য ঐ তেরটি পণের অনুসাধনমূলক কর্মপ্রবতর্নের ভিতর দিয়ে যারা জীবনের পরিচালনা ও পূর্ণ পরিনতি লাভের জন্য প্রয়াসী, তাদের ‘ব্রতচারী’ আখ্যাদানের যে প্রস্তাব আমি উপস্থাপন করি তা ঐ (শিক্ষা) শিবিরবাসী সকলেই অতি আগ্রহের সহিত অনুমোদন করেন। এই ঘটনাটি হয় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের (১৯৩২ খৃ:) ২৩ শে মাঘ তারিখে। আমার জীবনে বাংলার জাতীয় আত্মার চেতনা পূনঃপ্রতিষ্ঠার গভীর আকুতি পরিগ্রহ ও নাম পরিগ্রহ করে ‘ব্রতচারী’ নামে প্রকাশ লাভ করেছিল।” (বাংলার শক্তি, আষাঢ় ১৩৪৮)।

তিন মহান বাঙালীর মানসে বাঙালী-চেতনাকে উর্ধে তুলে ধরা এবং বিশ^-বাঙালীর চিন্তা ধারণ করার বিষয়ে সমচিন্তার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের  ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে আবেগময় বক্তৃতা প্রদানকালে মাত্র তিনটি শব্দে আত্মপরিচয় তুলে ধরেছিলেনঃ ‘আমি বাঙালী, আমি মুসলমান, আমি মানুষ:। তিনি ছিলেন বাঙালী জাতিয়তাবাদের ধারক-বাহক, ধার্মিক পরিচয়ে তিনি মুসলমান। একই সাথে বিশ^মানব পরিবারের তিনি একজন। কবির ভাষায় ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বিশে^র নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিলেন তিনি। তাঁর ভাষায় “বিশ^ দু’ভাগে বিভক্ত-শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে”। এমন উক্তির মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ^-বাঙালী। অপর বিখ্যাত বাঙালী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বিশ^কবি নামেই খ্যাত। নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে তিনি বিশ^ময় ছড়িয়ে পড়েছিলেন, বিশে^র সাহিত্য দরবারে স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন। গুরুসদয় দত্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পূর্বসুরী এবং কবিগুরুর সমসাময়িক। পরাধীন ভারতের আই.সি.এস অফিসার হয়েও তিনি ব্রতচারীর মূলমন্ত্র ঘোষণা করলেন, “বিশ^মানব হবি যদি, শাশ^ত বাঙালী হ”। তিন বাঙালীর মানসে বিশ^মানবের প্রতিচ্ছবি বুঝি ভবিষ্যতে বাঙালী জাতির আত্ম-পরিচয় জেগে ওঠার পূর্ব লক্ষন ছিল।

১৯৬৯ সনের বিশাল গণ জাগরণ তথা সর্বব্যাপী গণআন্দোলনের মাঝে জন্ম নিয়েছিল ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান যা নাকি জাতির ঐক্যকণ্ঠের প্রেরণা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বজ্রকণ্ঠে রূপ নিয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, এর চারদশক আগে গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারীর জাতীয় সঙ্গীতে গেয়ে উঠলেন,
“চিরধন্য সুজলা ভূমি বাংলার,
জয় জয় সোনার বাংলা,
জয় জয় ভাষার বাংলা,
জয় জয় আশার বাংলা।”

কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমার ভালবাসি’  কবিতাটির তো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে উত্তরণ ঘটলো একাত্তরের স্বাধীনতার পর। বাংলার মাটির টান, ভাষার টান বুঝি তিন শাশ^ত বাঙালীকেই আবেগাপ্লুত করেছিল। তাই শুধু আবেগের মিলই নয়, আবেগ প্রকাশের ভাষারও মিল লক্ষ্য করা যায় তিনজনের উচ্চারণে। শাশ^ত বাঙালী মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে। সর্বকালেই তারা ছিল অসাম্প্রদায়িক। অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরাজিত করার পর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কবি মানসে অসাম্প্রদায়িকতা ছিল বলেই কবিগুরু বিশ^কবি হয়েছিলেন। আর গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী শিক্ষায় অসাম্প্রদায়িকতা মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর ব্রতচারী সঙ্গীতেঃ
“জগত পিতার অংশ মোরা যতেক ভগ্নি-ভাই,
মানুষে মানুষে কোন জাতের বিভেদ নাই।”

গুরুসদয় তাঁর আরেকটি গানে মুসলিমদের একটি ট্রাজেডিকে মানব ট্রাজেডিতে রূপান্তর করে গেয়ে উঠেছেন,
“কারবালাতে ইমাম হোসেন, কাশেম দিলেন প্রাণ,
তারি লাইগা বাংলায় কান্দে হিন্দু-মুসলমান।”

বাংলার লোকনৃত্যকে শরীরচর্চায় ব্যবহার করে এবং দেশপ্রেম ও নীতিকথাকে গানে গানে প্রকাশ করে, গানের সাথে নৃত্যের সমন্বয় ঘটিয়ে গুরুসদয় ব্রতচারীর প্রবর্তন করেছিলেন। শরীরচর্চায় নৃত্যের সংযোজন গুরুসদয়ের বিস্ময়কর অবদান। ইতিপূর্বে স্কাউট আন্দোলন শিক্ষনীয় ছিল। কিন্তু ব্রতচারী আন্দোলনে শিক্ষার সাথে আনন্দ যোগ হল, লোক সংস্কৃতি যুক্ত হলো। ব্রতচারী গানে কিশোর-তরুণদের কণ্ঠে শপথ উচ্চারিত হতে লাগলো এবং বারংবার উচ্চারণে মন-মানসে গেঁথে গেলোঃ
“গুরুজনকে মানব; লিখব পড়ব জানব।”
“বিপদ বাধায় ডরিব না, বিফল হলেও ভাঙ্গিব না।”
“কোঁচা ঝুলাইয়া চলিব না, খিচুড়ি ভাষা বলিব না।”
“অসম্ভব কিছু নয়, সাধনাতে সব হয়।”
“মন দুরস্তে তন দুরস্ত, তন দুরস্তে মন দুরস্ত।”
“ রাগ, ভয় ঈর্ষা, লজ্জা, ঘৃনা; পাঁচ দোষ ব্রতচারীর মানা।”

এমনি অনেক নীতিকথা সন্নিবেশ করে রচিত হয়েছে ব্রতচারী গান। আর নৃত্যের তালে তালে গান গেয়ে ব্রতচারীর হয় তন্ দুরস্ত এবং মন দুরস্ত। গুরুসদয় সম্ভবত স্কাউট আন্দোলনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করে বাঙালী সংস্কৃতির প্রতিফলনে ব্রতচারী আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই ব্রতচারীতে সন্নিবেশিত হয়েছিল বাংলা ভাষা, লোকনৃত্যের আদলে নৃত্য, দেশজ নীতিকথা ও লোকজ আচার-আচরণ। গুরুসদয়ের মনের মনিকোঠায় ছিল বাংলার মাটি আর বাঙালীর জয় যা তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে ;
মানুষ হ’, মানুষ হ’
আবার তোরা মানুষ হ;
কায়মনে বাঙালী হ’ ।
শিখেনে দেশ-বিদেশের জ্ঞান
কভু হারাস নে মা’র দান;
বাংলা ভাষায় বুলি চেলে,
বাংলা ধাঁচে নেচে খেলে,
বাংলা ভাবে পরান মেলে
বাংলার সেবায় জীবন ঢেলে
কায়মনে বাঙালী হ;
ষোল আনা বাঙালী হ;
বিশ^ মানব হবি যদি
শাশ^ত বাঙালী হ’

অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জাতীয়তাবোধের ধারক গুরুসদয়ের প্রতি আমরা কি অধিকতর সদয় হতে পারি না? স্বাধীন বাংলাদেশে গুরুসদয়ের ব্রতচারী আন্দোলন তথা শাশ^ত বাঙালী হবার আহ্বান ভিন্ন মাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু স্বীয় সংস্কৃতির ব্রতচারী চর্চার সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করে ‘গেয়ো যোগী ভিখ পায় না’। দেশে অপসংস্কৃতির বিস্তার এবং মূল্যবোধের সংকট মোকাবিলায় দেশের সকল স্কুলে ব্রতচারী চর্চা প্রবর্তন এখন সময়ের দাবী। সবশেষে ব্রতচারী আন্দোলন সম্বন্ধে কবিগুরুর একটি মন্তব্য উল্লেখ করছি, “এই ব্রতচর্যা পালন করলে প্রাণের আনন্দ, কর্মের শক্তি, চরিত্রের দৃঢ়তা ও লোকহিতের সাধনের উৎসাহ দেশে বললাভ করবে, তাতে সন্দেহ নাই।”

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে