আনজীর লিটন
ষাট বছর পেরিয়ে এল কচিকাঁচার মেলা।
আমাদের সমাজ জীবনে যে আলো কচিকাঁচার মেলা ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই আলোর ভুবনে দাঁড়িয়ে আজ খুঁজে বেড়াই দাদাভাইকে। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, যিনি বাংলা ও বাঙালির সত্ত্বাকে লালন করে গেছেন। আদর্শগত চেতনায় মুক্ত মনের মানুষ হওয়ার শিক্ষা প্রদান করেছেন সংগঠনের মাধ্যমে, তাঁর লেখনির মাধ্যমে। আজ কচিকাঁচার মেলার এই দীর্ঘ পথচলার আলোয় আমরা খুঁজি কবি বেগম সুফিয়া কামালকে। খুঁজি বিজ্ঞান লেখক আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনকে। তাঁদের হাত দিয়ে গড়া এই সংগঠনটি আমাদের জীবন গঠনে পথ দেখিয়েছে।
আমাদের বেড়ে ওঠার কালে কচিকাঁচার মেলা ছিল। তারও আগে ছিল। এখনো আছে। থাকবে। কচিকাঁচার মেলার এই যে অন্তহীন যাত্রা-এই যাত্রায় কত-কত মানুষের মিলন ঘটেছে। এ যে মহামিলনের যাত্রা। আর এই মহামিলনের মহা আয়োজনে টুকরো-টুকরো আলোয় আমরা উজ্জ্বল হতে শিখেছি। আমরা দেশকে চিনেছি। দেশের মানুষকে চিনেছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে জেনেছি। আমরা প্রকৃতিকে চিনেছি। আলোর নিচে বসে আমরা ছবি এঁকেছি। গল্প-কবিতা-ছড়া লিখেছি। আমরা গান গেয়েছি। টেলিস্কোপে চোখ রেখে নক্ষত্র খুঁজেছি। কচি-কাঁচার মেলায় ছড়ানো আলোয় আমরা রাজপথে হেঁটেছি। মুক্তির শপথ নিয়েছি। আমরা জীবনবোধের ব্যাকরণ শিখেছি। ভালো আর মন্দের ব্যবধান জেনেছি। শুধু তাই নয় সততার সংজ্ঞা শিখেছি। সত্যের মর্ম বুঝেছি। বড়দের শ্রদ্ধা করতে জেনেছি। ছোটদের ¯েœহ করতে শিখেছি। সমবয়সীদের সঙ্গে হুল্লোড়ে মেতে উঠার নানা ছন্দ শিখেছি।
কচিকাঁচার মেলা বিশ্বাস করে শিশুরাই বিশ্বের আশা। বিশ্বকে সৌন্দর্যম-িত করতে হলে তাই শিশুদেরকে গড়ে তুলতে হবে যোগ্য নাগরিক হিসেবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার নিয়ে জাতিসংঘ প্রণয়ন করেছে শিশু অধিকার সনদ। জাতিসংঘ শিশু সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন। এই সনদে বলা হয়েছে শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার শিশুর জন্মগত। শিশুদের আছে শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, সুস্থ্য সামাজিক পটভূমিতে বেড়ে ওঠার অধিকার, খেলাধূলা ও বিনোদনের অধিকার, দূর্যোগ মোকাবেলায় সাহায্য-সহযোগিতা পাবার অধিকার। মোট ৫৪টি ধারায় বর্ণিত শিশুদের এইসব মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ শিশু সনদকে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করতে প্রথম যে ২০টি দেশ স্বাক্ষর দান করেছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এটা আমার জাতির জন্য গৌরবময়।
কচিকাঁচার মেলা শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে গড়ে উঠেছে এবং সেই প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলছে। জগৎ পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে জীবনবোধের নানান আয়োজন। সেই রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-প্রেত, পাতালপুরী, রাজকুমার-রাজকুমারী, সোনারকাঠি-রূপারকাঠির জায়গা দখল করে নিয়েছে বিজ্ঞান। আজকের দুনিয়া তথ্যপ্রযুক্তির নানা আলোয় উদ্ভাসিত। শিশুদের হাতের নাগালে চলে এসেছে তথ্য প্রযুক্তি। পাল্টে গেছে শিক্ষার ধরণও। তাই বলে মানবিক মূল্যবোধের গুণাবলী কখনই হারায় না। কখনও হারায় না সত্য, আদর্শ ও উদারতার গুণ। সমাজ, মানুষ আর মানুষের রাজনীতির মধ্যে যত বিভেদই তৈরি হোক না কেন প্রতিটি শিশু সাম্য ও সমতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে। এখানে থাকতে হয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে নতুন থেকে নতুনের দিকে এগিয়ে চলার যে শিক্ষা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক, সেই শিক্ষাই দিতে পারে শিশুদের জন্য গড়ে ওঠা সংগঠন। কচিকাঁচার মেলা তারই স্বাক্ষর বহন করছে।
কচিকাঁচার মেলা আর দাদাভাই সমার্থক নাম। এই দুটো নামের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর পাতা দিয়েই। ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে বলতে পারি এ আসরই আমার জীবনপাতায় রচনা করেছে লেখকসত্ত্বা। দাদাভাইয়ের ওই প্রশ্রয়টুকু, ওই আদরটুকু না পেলে আমি কি হতে পারতাম এই আনজীর লিটন ? শুধু আমি কেন? আমাদের দিনে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকদের প্রায় বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে দাদাভাইয়ের কাছে, কচিকাঁচার কাছে। কচিকাঁচার মেলা বাঙালি জাতির এক গৌরবময় প্রতিষ্ঠান। আর এই প্রতিষ্ঠান শিশুদেরকে শুধু সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়নি। দিয়েছে শিশু সাহিত্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার স্বপ্নময় রঙিন জগৎ। ইত্তেফাক পত্রিকার কচিকাঁচার আসরকে ঘিরে বাংলা শিশু সাহিত্য বর্ণিল হয়ে উঠেছে। সমৃদ্ধ হয়েছে বর্ণাঢ্য সব রচনা দিয়ে। শিশু সাহিত্যের প্রতিটি রচনা কল্পনার মধ্য দিয়ে বাস্তব ঘটনার সংমিশ্রণ। এখানে আনন্দ থাকে। থাকে তথ্য, সঠিক ইতিহাস আর মায়াবী পরিবেশ প্রকৃতির কথা। মননশীল, কালজয়ী, শিশুপাঠ্য রচনায় শিশু সংগঠনগুলোরও ব্যাপক ভূমিকা থাকে। কচিকাঁচার মেলা সেই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে শিশু সাহিত্যিকদেরকেও লালন করেছে যতনের সঙ্গে। দাদাভাইয়ের আন্তরিকতায় এ কাজ আরও বেগবান হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন শহরে দাদাভাইয়ের শিশু সাহিত্যিকদের নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। আয়োজন করেছেন সাহিত্য আসরের। এই স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িত করে। এসব সাহিত্য আসরের মধ্য দিয়ে দাদাভাই যে তথ্যটি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তা হলো, সুন্দরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার সাহস সঞ্চয় করতে হয়। মানুষে মানুষে অপরূপ বন্ধনে সমাজ গড়ে তুলতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন পারিবারিক শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্বময় পরিবেশ, একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা। কচিকাঁচার মেলা থেকে এই বাণীটুকু উপলব্ধি যারা করতে পেরেছে তারাই আজকে সমাজ গঠনে প্রধান শক্তি। তাঁদের আছে মুক্তচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা।
আজকের শিশু আগামীদিনের নেতৃত্বদানকারী। মুক্তচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধি চর্চার মধ্য দিয়ে এই শিশুদের বেড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশে মানসিক গঠন তৈরি করা, বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া, শারীরিক গঠনের প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং শিল্প-সংস্কৃতির নানা শাখায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার মধ্য দিয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার পথ তৈরি করে দিতে হবে। তাহলেই আমরা পাবো সচেতন নাগরিক, পাবো আগামী দিনের শান্তি সুখের সমৃদ্ধময় বাংলাদেশ।
কচিকাঁচার মেলা সেই প্রত্যয় নিয়ে জেগে থাকুক জনম জনম ধরে।
0 Comments