Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

মেলার আঙ্গিনা ভরে উঠুক হৃদয়ের ঝংকারে


                                                              ইউসুফ খসরু

আজকের ‘আমি’ থেকে ইউসুফ খসরু হয়ে ওঠার পেছনে কচিকাঁচার মেলার অবদান প্রায় পুরোটাই। একটি যোগ্য প্রতিষ্ঠানের সান্নিধ্য পেলে একজন শিশু পায়ে পায়ে কিভাবে একজন সুনাগরিকে পরিণত হয় তার অন্যতম প্রমাণ কচিকাঁচার মেলা। প্রথমে আমি কেন্দ্রীয় মেলার সদস্য ছিলাম। পরে দাদাভাইয়ের উৎসাহ ও প্রেরণায় নাখালপাড়া মধুমাখা কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। এ মেলার প্রথম সংগঠক ছিলাম আমি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মেলার খেলাধুলা বিভাগে কাজ করতাম।

স্বাধীনতার পর পর, তখন কেন্দ্রীয় মেলার অফিস ছিল ঢাকার আরকে মিশন রোডে। এরপর অফিস স্থানান্তর হয় পল্টনে। পল্টনের অফিস আমার স্মৃতিতে নানাভাবে জড়িয়ে আছে। অফিস ভবনটি হয়তো পুরনো ছিল। স্থান ছিল সংকুচিত। শিল্প বিতানের ভাই-বোনেরা টিনশেডের ঘরে ক্লাস করতো। অতো ছেলেমেয়ের মধ্যে ঐটুকু জায়গা। ইজেল রাখা, তাতে ক্যানভাস সাজানো, রঙতুলির ট্রে রাখার স্থান সবই অই সামান্য জায়গাতেই।

তাই বলে কারও মনে আক্ষেপ ছিল না। দুঃখ ছিল না। হাসিমুখ সবাই যার যার কাজটি করে গেছে। এবং সে সময়ে দারুণ দারুণ সব ছবি আঁকা হয়েছে। তাদের অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। কেউ স্থপতি। এছাড়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তো আছে অনেক। সংগঠনে থাকলে লেখাপড়ার ক্ষতি হয় এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। মেলার সবার কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল এবং প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করে তারা সে সত্যই প্রমাণ করেছে। আমি নিজে কেন্দ্রীয় মেলার ছাড়াও সারা দেশে ঘুরে বেড়াতাম। বিভিন্ন শাখা মেলার ভাই-বোনদের ড্রিল, পিটি, শরীরচর্চা, লড়ি নৃত্য প্রভৃতি খেলা শেখাতাম। দাদাভাইয়ের নির্দেশেই ঘুরে বেড়াতাম এসব অঞ্চলে। তারপরও বলবো পড়ালেখার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি নিয়ে এমএ পাস করতে পারতাম না। আসলে ইচ্ছেটাই হচ্ছে একজন শিশুর সবচেয়ে বড় শক্তি। বিভিন্ন শাখা মেলায় ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে যেমনি অন্যরকম আনন্দ ছিল, তার চেয়ে বড় আনন্দ ছিল বাংলাদেশটা ঘুরে দেখার আনন্দ। বিভিন্ন শাখা মেলায় যখন কেন্দ্রীয় মেলার নেতৃবৃন্দের ভ্রমণ পরিকল্পনা হতো তখন অগ্রিম দল হিসেবে আমরা আগেই চলে যেতাম সেসব মেলায়। গিয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও ভাই-বোনদের সঙ্গে মিলেমিশে প্রোগ্রাম তৈরি করতাম। ভীষণ মজা হতো তখন। এরপর আমাদের কাজ মনিটর করার জন্যে যেতেন ইউসুফ ভাই কেফায়েত ভাই এরা। তারপরেই ভ্রমণে আসতেন মূল দল। যেখানে দাদাভাইয়ের নেতৃত্বে সুফিয়া খালা, মুতিভাইসহ বিভিন্ন জ্যেষ্ঠরা থাকতেন সে দলে। শ্রীমঙ্গলে যখন আমরা ভাই-বোনদের লড়িনৃত্য শেখাচ্ছিলাম সেখানেই এক সময় দাদাভাই নৃত্যের তালেতালে গলায় ঢোল তুলে নেন। যে ছবিটি পরে বিখ্যাত হয়। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সেই ছবিটি।

কচিকাঁচার মেলার স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য একসময় সেগুনবাগিচায় জায়গা মেলে সরকার থেকে। সে জায়গা দেখভালের জন্য দায়িত্ব পড়ে আমাদের মত তরুণদের ওপর। সরকার যেদিন মেলাকে সেগুনবাগিচার জায়গাটি বুঝিয়ে দেয় এবং মেলার পক্ষ থেকে জায়গাটি বুঝে নেয়া হয়, সেদিনের কথা কখনও ভোলার নয়। স্মরণীয় সে দিনটিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন মেলা থেকে কয়েক হাজার ভাইবোন এসে জড়ো হয়। সবাই মিলে মাটি ভরাটের কাজে অংশ নেয়। ছোট ছোট ভাইবোনেরা দুহাতে আজলা ভরে বালু নিয়ে জমিতে ফেলতো। যা ছিল ভাইবোনদের এক প্রতীকি অংশগ্রহণ। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে জমি ভরাটের কাজ। তখন জায়গাটি ছিলো পুরোপুরি এক জলাভূমি। উরু অবধি জল ছিল সে জমিতে। সে জল যেমনি ছিল পঁচা, তেমনি ছিল দুর্গন্ধময়। দিনরাত সে জলে দাঁড়িয়ে জমি ভরাটের কাজ তদারকি করতাম আমি, হাবিব, কেফায়েৎ ভাই স্বপন এবং সে সময়ের আরও অনেক বন্ধুরা। দুষিত জলের ছোঁয়ায় আমাদের সবার পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল। জমি ভরাটের পর চারদিক থেকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। জমির বুকে মেলার নামে সাইনবোর্ড পুঁতে দেয়া হয়। কিন্তু কদিন বাদেই দেখা দিল নতুন এক উপদ্রব। রাতের অন্ধকারে কারা যেন কাঁটাতার খুলে নিয়ে যেত, সাইনবোর্ড গায়েব করে ফেলতো। ফের সাইনবোর্ড দেয়া হতো, কাটাতারে ঘেরা হতো জায়গা। কিন্তু একইভাবে অদৃশ্য কোনো ইশারায় সেসব স্থাপনা সরিয়ে ফেলা হতো।

একসময় শুধু সরিয়েই ওরা খ্যাত হলো না। রাতারাতি সে জমিতে পুরির দোকান, চায়ের স্টল, সেলুন আরও নানা রকমারি দোকান বসে গেল। তাদের উঠে যাবার জন্যে বিভিন্ন সময়ে অনুরোধ করা হল। বোঝানো হল। কিন্তু ওরা সে জায়গা ছাড়ে না। কোনোভাবেই জায়গা থেকে ওঠে না। রীতিমত দখল করে নেবার পাঁয়তারা। দখল রাখার জন্য ওরা সবাই মিলে এক জোট হয়। এ দেখে দাদাভাই বড্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান। দাদাভাইকে আমরা দুঃচিন্তামুক্ত করার চেষ্টা করলাম। তিনি কতটা আশ্বস্ত হলেন ঠিক বোঝা গেল না। তবে দখলদারদের শেষবারের মত আবারও বোঝানো হলো, অনুরোধ করা হলো দখল ছেড়ে দেবার জন্য। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হলো না। তারপরও সময় দেয়া হল্ োবিপদের কথা বলা হলো। আইনভঙ্গের কথা বলা হল। তাতে মুখে মুখে ওরা সায় দিলেও দখল কিন্তু আর ছাড়ে না। শেষে একরাতে আমরা বন্ধুরা এলাম হোন্ডায় চড়ে। সঙ্গে ঠেলাগাড়ি অনেকগুলো। ঘর এবং দোকানের ভাঙা জিনিশপত্র একসময় ঠেলাগাড়িতে তুলে দেয়া হলো আর বলা হলো এগুলো তোমরা নিয়ে বিক্রি করে দাও। ওরা খুশি মনে রাতের অন্ধকারে সব ভাঙা স্তূপ সরিয়ে ফেলল।

আমরা ফের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিলাম জায়গা। সাইনবোর্ড বসালাম। কিন্তু এসব গায়েব করার তৎপরতা ঠিকই রইলো। কিন্তু ঘর তোলার, দোকান বসাবার সাহস আর হয়নি ওদের। এর জন্যে অবশ্য আমাদের বিকেল-সন্ধ্যা নিয়মিত পাহাড়া দিতে হত। আমি কেফায়েত ভাই, হাবিব, স্বপন আমরা সবাই হোন্ডায় চড়ে আসতাম এবং এ জায়গায় বসে আড্ডা দিতাম। আমাদের একটাই পণ, যেকরেই হোক জমির দখল ধরে রাখতে হবে। তখন জমির দখল ঠিক রাখার জন্য দাদাভাইয়ের পরিচিত একলোককে ঘর করে সেখানে থাকার অনুমতি দেয়া হলো। মূলত মেলার জায়গা পাহারা দেবার জন্য এবং জমির দখল ধরে রাখার জন্য সেখানে থাকার অনুমতি দেয়া হয় তাকে। কিন্তু বেড়ায় যদি ক্ষেত খেয়ে ফেলে তখন কী দশা হয়। লোকটি মেলার জায়গায় শুধু থাকতোই না, তার পরিবারসহ থাকতো। সে সঙ্গে তরিতরকারি নানারকম সবজি চাষ করতো লোকটি। গরু পালতো বেশ কটি। অর্থাৎ মেলার জায়গায় তার শুধু আশ্রয়ই জোটেনি সেসঙ্গে রুটি-রুজির ব্যবস্থাও হয়ে যাচ্ছিল দিব্যি। একসময় মেলার জায়গাটি তাকে ছেড়ে দেবার জন্য বলা হয়। মেলার নিজস্ব ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা চলছিল তখন।

কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তির ইশরায় সেও জমির দখল ছাড়াতে টাল-বাহানা শুরু করলো। শেষে তাকেও অনেক কষ্টে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হল। সে সময়ে আমজাদ ভায়ের সহায়তায় নরওয়ে সরকার থেকে মেলার নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য ফান্ড পাওয়ার ব্যাপারে কথা চলছিল। তখন সাহস করে দাদাভাইকে একদিন বললাম, এখানে একটি অডিটোরিয়াম হলে খুব ভাল হয়। আমি যেহেতু নাটকের লোক তাই আমার স্বপ্নে ছিল একটি সুন্দর অডিটোরিয়াম। দাদাভাইকে আরও বললাম, যদি অডিটোরিয়াম হয় তাহলে রামেন্দু মজুমদার, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের পরামর্শ নিতে পারেন। দাদাভাই তাদের পরামর্শ নিয়েছিলেন কি না জানিনা তবে অডিটোরিয়ামসহ সুউচ্চ একটি ভবন সেখানে দাঁড়িয়েছে। মেলার নিজস্ব ভবন। এ ভবনের দিকে যখন তাকাই গর্বে বুক ভরে যায়। এ মেলা আঙিনায় যখন পা রাখি পরম শান্তিতে মন ভরে যায়-এ আমার নিজের মাটি। এ মাটি আমাদের। প্রতি মুহূর্তে মেলার ভাইবোনদের, শিশু-কিশোরদের হাসিতে ভরে থাকুক এ আঙিনা, এটাই আমার চাওয়া। হৃদয় নিংড়ানো চাওয়া।

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে