Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

শিশুমনের বিকাশে নান্দনিক চেতনা


                                                               আনিস রহমান

একজন মানুষের ভেতর আসলে অসংখ্য মানুষের বসবাস। এ কথা আমরা সবাই জানি কিংবা জানি না। তবে অনেকেই জানি। যারা জানি কিন্তু বুঝি না। আবার যতটুকু বুঝি ঠিক তলিয়ে দেখি না, গভীরে যাই না। যাই না বলেই হয়তো শাশ্বত এ সত্য ভাষা পায় না তেমন জোরালো ভাবে। এ সত্যের মর্মবাণী সেভাবে আলোকিত করে না আলোড়িত করে না আমাদের। যদিও প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই আমরা মুখোমুখি হই একজন মানুষের ভেতর অসংখ্য মানুষের। এর দৃষ্টান্ত খুঁজতে খুব বেশি দূরে যাবার দরকার নেই-কাছে পিঠের কোনো দুরন্ত শিশু-কিশোরদের মধ্যেই রয়েছে এর প্রকাশ।

একজন শিশু এই মাত্র হয়তো নাচের ক্লাশ শেষ করে বেরিয়েছে। গানের সুর ও ছন্দে, আনন্দে-আনন্দে নানাভাবে ঝংকৃত হয়েছে আলোড়িত হয়েছে সে। কথা ও সুর ভাষা হয়ে প্রকাশ পেয়েছে শারীরিক নানা মুদ্রায়। পরক্ষণেই রঙ-তুলিতে ছবির প্রকাশ দেখি কার্টিজ পেপারের চৌহদ্দিতে। এখানেও ভাষা পেয়েছে তবে নাচের মুদ্রায় নয়, ভাষার প্রকাশ দেখি ছবিতে। ছবিগুলো যেন এখন নয়, আরও আগেই আঁকা হয়ে গেছে, হয়েছে ওর হৃদয়পটেÑ মনের গভীরে। এখন কেবল তার প্রকাশ ঘটছে কাগজের বুকে। আঁকার কুশলতাতো আছেই। ড্রইং-স্কেচে ফুটে উঠছে নানা অবয়ব একেক জনের হাতে। সে আঁকা পূর্ণতা পাচ্ছে রঙের মিশেলে। রঙেরও আবার নানা বাহার।

মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙ চড়াচ্ছে ছবির গায়ে। রঙে রঙে নতুন ভূবন তৈরি হচ্ছে কাগজের বুকে। এক একটি কাগজ এক একটি ভূবন। স্বতন্ত্র ওরা। একই রঙ একই পেন্সিল থেকে ছবির প্রকাশ। তারপরও বিষয়ের অভিনবত্বে রঙের কারুকার্যে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত প্রতিটি ছবি। একই ঘরে একই চাতালে একই মাপের কাগজে এবং একই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ছবি আঁকা হলেও আঁকিয়ের শারীরিক গঠনে এবং মুখের আদলে যেমনি ভিন্নতা রয়েছে তেমনি ভিন্নতা রয়েছে তাদের অন্তরে, হৃদয়ে ও মনোভূমিতে। প্রতিটি হৃদয় স্বতন্ত্র বলে, প্রতিটি মনোভূগোল স্বাতন্ত্রম-িত বলে তাদের প্রত্যেকের প্রকাশ ভিন্ন, স্বকীতায় পূর্ণ ও বৈচিত্রে ভরপুর। আবার ঐ শিশুর কথাই যদি ধরি যে নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে মুদ্রায়। ছবির বুকে ভাবনা পেয়েছে রঙের কারুকাজ। আবার তাকেই দেখছি মঞ্চে বক্তৃতা করছে। আবৃত্তি করছে কবিতা। কবিতার শব্দে বাক্যে উপমায় লুকিয়ে থাকা অলঙ্কার, তার লাবণ্য মঞ্জুরিত হচ্ছে, শোভিত হচ্ছে তার কণ্ঠে।

মানুষ প্রত্যেকেই কী অবয়বে কী তার আদলে যেমনি স্বাতন্ত্র নিয়ে আছে, তার মনোগঠনেও তেমনি অদ্ভুত এক স্বাতন্ত্র বিদ্যমান। কিন্তু ঐক্য রয়েছে মনের ভেতরে মনের মানুষে। এক মানুষে বহু মানুষের যে বিভাজন, তার উপস্থিতি লক্ষ করা যায় মনের মানুষে। অর্থাৎ এক মনের ভেতর আবার অনেক মনের বাস। একমন ও অনেক মনের রহস্য আবার এক শরীরেরই বিরাজমান। অর্থাৎ এক মানুষের ভেতর বসত করছে অনেক মনের মানুষ। সেই মন কখনও বাবা হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। কখনও পাচ্ছে সন্তান হয়ে। নিজের সন্তানের কাছে তিনি বাবা। আবার তাঁর বাবা-মায়ের কাছে তিনি সন্তান। তিনিই আবার স্বামী। তিনিই আবার কারও সহকর্মী। কারও বন্ধু কারও আবার মামা কিংবা কাকা। অথবা কারও মেয়ে জামাই। তিনি কারও নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা। আবার তিনিই কারও অধস্তন কর্মচারী। এমনি করে একই মানুষের ভেতর আসলে অনেক মানুষের বসবাস, তাদের জীবন-যাপন ও অবস্থান। তারা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। নতুন সত্তার প্রকাশ ঘটছে তাদের আচরণে। বিস্ময়করভাবে বিভিন্ন চরিত্রে তিনি রূপদান করছেন এবং সফলভাবে তা উৎরেও যাচ্ছেন। একই সময়ে বাবা হয়ে সন্তানকে শাসন করছেন। পরক্ষণেই নিজেই সন্তান হিসেবে নতজানু তার বাবার সামনে। তখনই আরেকজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলছেন টেলিফোনে। সেখানে কর্তৃত্বের সুর না হয় বন্ধুবাৎসল্যে বিগলিত হাস্যরসের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে বাঁধ ভেঙে।

একই মানুষের ভেতর অনেক মানুষ, অনেক তার মন। এখানে বাহ্যিকভাবে অবয়বগত বা শারীরিক বিবেচনায় একটি মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও বহুমাত্রিক মন নিয়েই তার অবস্থান। সে মনের একদিকে কালো আর একদিকে আলো যদি থাকে তাহলে খুব কী অবাক হব? কোনো মনই পুরোপুরি আলোয় ভরা কিংবা কালোয ঢাকা নয়। আলো আঁধারির মিশেল নিয়ে বসত করছে প্রতিটি মন। আলোর পড়শি কালো না হয় কালোর পড়শি আলো হয়ে। তাইতো কোনো মানুষের এক মন যখন স্নেহশীল বাবা আবার তার অন্য এক মন জীঘাংসায় মেতে উঠছে গোপনে-নীরবে। এখানেই মানুষের ভেতর আমরা পশু শক্তির উন্মেষ দেখি, দেখি তার বিনাশী আয়োজন। মানুষের ভেতর পশুত্ব আছে এবং তা থাকবেই। তবে তাকে গুহায় আবদ্ধ করে রাখতে হবে সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে। এ অনুশাসনের মধ্যে আবার রয়েছে সামাজিক শিক্ষা। সামাজিক শিক্ষা তখনই জোরদার হয় এবং শিক্ষাটি সুশিক্ষায় পরিণত হয় যখন তাতে সাংস্কৃতিক বন্ধনটি থাকে গভীর এবং শেকরবাহী।

শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষার সঙ্গে যদি সাংস্কৃতিক শিক্ষার মিশেল ঘটে, সে শিক্ষা একজন মানুষের মনে আসলে নতুন এক মাত্রার সংযোজন ঘটায়। যা সে মানুষটিকে এক গভীর প্রত্যয় নিয়ে পরিচালিত করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার মনে এক গভীর দার্শনিক স্তরান্তর ঘটায়। যা তাকে কিংবা তার ভেতরের মানুষকে কিংবা তার সত্তাকে এক মৌলিকদর্শন দান করে। যা এক আলোকবর্তিকা হয়ে আজীবন তাকে আলো দান করে। তার চলার পথের অন্ধকারকে দূর করে এবং নানা চড়াই-উৎরাই মাড়িয়ে জীবনের লক্ষ্যে কিংবা গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে।

এমনি একটি বহুমাত্রিক শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হচ্ছে কচি-কাঁচার মেলা। কেন্দ্রীয় মেলার পাশাপাশি অসংখ্য শাখা মেলার সমন্বিত প্রয়াস নিয়ে মেলা তার শিখন কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে তা আজ ক্রমাগত ষাট বছর ধরে। মেলার অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন হলেও দর্শনগত কোনো প্রভেদ নেই। সব ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশটাই মুখ্য। শুধু বিকাশ নয়, তাদের মানসিক গঠনটাও বিবেচ্য। পরিণত গঠন ছাড়া কোনো মন স্থায়ী হয় না। যে কোনো সময় সে মনের গাঁটছড়া ভেঙে তার বিকাশ অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। তাই মেলার শিক্ষা কাঠামোতে মনোগঠনের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে থাকে।

মেলার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই দীর্ঘ সময়ে অগুনতি শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক শিক্ষা গ্রহণ করে আজ দেশে-বিদেশে নানা দিকে নানামুখী কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এ মানুষগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সনদ লাভ করেছে ঠিকই কিন্তু সামাজিক শিক্ষা তাকে দিয়েছে এক আলোর স্তম্ভ যা দিয়ে সে তার কর্মক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র মাত্রা সংযোজন করে ভিন্ন পরিচয়ে পরিচয় লাভ করেছে। সবসময় অন্ধকারকে পায়ে মাড়িয়ে আলোর দিকে যাত্রা করেছে। কখনও আলোর স্তম্ভ দুহাতে মাথার ওপর তুলে ধরে দূরের অন্ধকারকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করেছে আরও দূরে। নির্বিঘœ করে নিচ্ছে ওর চলার পথ। এ আলোর স্তম্ভ আর কিছু নয়- তার বিবেক। বিবেক যখন কাকতাড়–য়ারূপে একটি মানুষকে পাহাড়া দেয়, সেখানে অন্তত প্রকৃতির অশুভ অনুষঙ্গের উৎপাতের আশঙ্কা আর থাকে না। তেমনি প্রত্যেকটি শিশু-কিশোরের মনে আসলে একটি করে কাকতাড়–য়া গড়ে দিতেই কাজ করছে মেলা।

কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা কিংবা শাখা মেলা যেই হোক না কেন, তার অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূলে রয়েছে সৃজনশীলতার প্রকাশ। রয়েছে সাংস্কৃতিক শিক্ষার বিকাশ। সৃজনশীলতার মূলেও রয়েছে আসলে সংস্কৃতি। সে যে মাধ্যমেরই হোক। নাটক কিংবা কবিতা কিংবা কবিতা আবৃত্তি। গান না হয় নৃত্য। ছবি আঁকা না হয় গল্প বলা। কিংবা সাহিত্য পাঠ। সৃজনশীল শিক্ষার এমনি ধারা মানুষের হৃদয়কেই শুধু আলোকিত করে না, তার দৃষ্টিকেও দান করে এক গভীর নান্দনিক আবেদন। যা তার দৃষ্টিকে প্রভাবিত করে এবং করে শোভন, সুন্দর ও প্রাণময়।

দৃষ্টি কোথায়? দৃষ্টির ব্যঞ্জনা, প্রতিমা কিংবা আবেশ তৈরির পাদপীঠ কোথায়? সে কী চোখে নাকি অন্তরে? চোখ আমাদের দেখার মাধ্যম। কিন্তু দেখে আসলে অন্তর। অন্তর যেমনি নিরাকার, দৃষ্টিও তাই। অবয়বহীন অন্তরের মধ্যেই দৃষ্টির বসবাস। আবার দৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দৃষ্টিভঙ্গি। অন্তর যদি সুন্দর হয় তাহলে তারই অংশ দৃষ্টিও সুন্দর হতে বাধ্য। দৃষ্টি যেখানে শোভন-সুন্দর ও আদৃত হয়, দৃষ্টিভঙ্গিও সেখানে নান্দনিক ও অভিরুচিসম্পন্ন হওয়াই স্বাভাবিক।

এখন এই অন্তরের গড়ন বিনির্মাণে কোন নিয়ামক কাজ করে থাকে? বাতাস যেমনি দেখা যায় না কিন্তু তার প্রকাশ ঘটে গাছের পাতায়, নদীর ঢেউয়ে কিংবা ধানক্ষেতের সবুজ প্লাবনে। অন্তরও তেমনি দৃশ্যমান নয়। অধরা। অদেখা। কিন্তু তার প্রকাশ ঘটে তার কর্মে তার কথায় বা বাক্যালাপে। কথা তখনই সুন্দর হয়, যখন চিন্তা সুন্দর হয়। চিন্তা সুন্দর হয় তখনই যখন তার অন্তর বা হৃদয় সুন্দর ও সৌকর্যময় থাকে।

হৃদয়ের সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে তার গড়নের ওপর। আবার গড়নটি নির্ভর করে। যত না জন্মগতভাবে, তারচে অনেক বেশি তাৎপর্যময় তার বেড়ে ওঠা পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর। তারপরেই আসে শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাঠ্য পুস্তকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে দেয়। সেখানে বিষয়লব্ধ জ্ঞানই মুখ্য। যা শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নির্যাস থেকেই তার মানস গঠনের বীজ উপ্ত হয় গভীরভাবে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। একে শিক্ষার চেয়ে সুশিক্ষাই বলা অধিকতর শ্রেয়। সেক্ষেত্রে কচিকাঁচার মেলা একিট অপ্রাতিষ্ঠানিক প্লাটফরম হিশেবে নিরন্তর শিশু-কিশোরদের মানস গঠনে কাজ করে যাচ্ছে। গঠন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করছে তাঁরা সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষাটি হচ্ছে নীরবে। এখানে কোনো জোরাজুরি নেই। নেই বাধ্যবাধকতা বলে কিছু। অনেকটা নীরবে শিক্ষা নামের প্রলেপটি দিয়ে যাচ্ছে। একবার দিয়েই থেমে যাচ্ছে না। বারবার দিচ্ছে। দিচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির নানামাত্রা সংযোজন করে। সাংগঠনিক নানা প্রক্রিয়া ও কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে। এ দেয়া-নেয়ার প্রক্রিয়া নিরন্তর চলছে। চলছে অনেকটা নদীর বুকে চর জেগে ওঠার মত নীরব নিভৃতে।

স্রোতের টানে পলি ভেসে আসে। আবার পলির ভারে স্রোতের গতি হয়ে আসে মন্থর। জলের গতির সঙ্গে পলির ভেসে আসা এবং জলের ক্লান্তির ভিড়ে সে পলির তলানি হিশেবে সঞ্চিত হবার প্রক্রিয়ার মধ্যেই সৃষ্টির এক গভীর তত্ত্ব নিহীত। পলিরেণু স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়েই একসময় চাঁদের আদলে কিংবা কচ্ছপের পিঠের মত এক চিলতে চাঁদোয়ার মত ভেসে ওঠে মৃত্তিকার আবাস। ক্রমে সে জেগে ওঠে পুরো অবয়ব নিয়ে। সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ ঘাসের ভিড়ে দুরন্ত সবুজের সাড়া মেলে। এক সময় লতাগুল্মের ভিড় বাড়ে। ছড়িয়ে পড়ে তারা দ্বীপ কিংবা চরাঞ্চল জুড়ে। আঁকড়ে ধরে মাটি। ভাঙনরোধে সবুজের শেকড় ক্রমেই নিম্নগামী হয়। প্রবেশ করে গভীর থেকে গভীরতর আঙিনায়। এক সময় সবুজ ছাপিয়ে চারপাশে গড়ে ওঠে প্রাণের কোলাহল। জীবন সংগ্রামের এক নতুন দিগন্ত ফুটে ওঠে তখন। যেখানে বাধা আছে। আছে প্রতিবন্ধকতা। আছে বৈরীতা। বিরূপতাও সোচ্চার। তারপরও আছে দুচোখ ভরা স্বপ্ন। আর আছে স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর সংগ্রাম। জয় আর পরাজয়। দুয়েরই সমান সম্ভাবনা সেখানে। তবু কোনো পিছটানে সাড়া না দিয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে ওঠে তারা। পরাজয়-পরাভবকে তুচ্ছ করে, স্বপ্নকে সংগী করে এগিয়ে যায় তারা নতুনের আহ্বানে।

শিশুমানস গঠনে এবং শিশুমনের বিকাশের সংগে এর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে বলেই কথাগুলো বললাম। একজন শিশু সামাজিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিশেবে যখন কোনো প্রগতিশীল সংগঠনের সংগে সম্পৃক্ত হয় তখন সাংস্কৃতিক নানা কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার এক অবারিত সুযোগ তার সামনে এসে ধরা দেয়। সেখানে নাচ হতে পারে। গান হতে পারে। আবৃত্তি কিংবা অভিনয় কিংবা ছবি আঁকার ক্লাসও হতে পারে। হতে পারে বই পাঠের সুযোগ কিংবা মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো ক্রিকেট-ব্যাটে কিংবা ফুটবলের পায়ে পায়ে।

শেখাটাই হচ্ছে বড় কথা এবং তার সংগে থাকা চাই শেখার আগ্রহ। শেখার বিষয় যাই হোক কিংবা মাধ্যম-নতুন কিছু অর্জন মানেই একজন শিশু-কিশোর মনের অনেক পরিবর্তন। নিরন্তর শেখার মধ্যদিয়ে সে পরিবর্তনের ধারা ক্রমেই বেগবান হয়। যা এক সময় তাকে সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষে রূপান্তরিত করে। এ পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। হতে বাধ্য। কারণ শেখাটা শুধু হাতে-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্য দিয়ে নিরন্তর নানা বার্তা সে পেয়ে থাকে এবং যথারীতি তা পৌঁছে থাকে তার মস্তিষ্কে, তার চেতনায়। এমনি করে নতুন নতুন নানা মাত্রায় নানা আঙ্গিকে বার্তা যখন একটি মস্তিষ্কে অভিঘাত সৃষ্টি করছে, সেখানে ঠাঁই করে নিচ্ছে, তখন সেই বার্তার নির্যাস ক্রমাগত সঞ্চিত হয়ে একজন শিশুর মানস গঠনে এবং তার মধ্যে একটি আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টিতে গভীরভাবে সহায়তা করে থাকে। যা তার সামনে একটি আলোর বিন্দুর মত এসে দাঁড়ায়। তাকে পথ দেখায়। তার গন্তব্য সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, তার সামনে একটি স্বপ্ন এসে বাসা বাঁধে। দোল খায় সে স্বপ্ন। একটি দর্শন দানা বাঁধে। এমনি তাঁর হৃদয়ের গভীরে এক শিশুমানস গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে শিশুর নিজস্ব মনোভূগোল। এই গড়ন প্রক্রিয়াটি যেহেতু একটি ইতিবাচক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হয়। তাই শিশুর অর্জনটিও হয় দৃঢ়, স্বাধীনচেতা এবং সবধরনের ভয়ডরমুক্ত। সে থাকে তখন সকল লোভলালসার উর্ধ্বে।

ধারা যাক, রবিঠাকুরের গানে গানে নৃত্য পরিবেশন করছে একদল কিশোর-কিশোরী।

“আনন্দলোকে মঙ্গল আলোক
বিরাজ, সত্য-সুন্দর।
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহা
গগন মাঝে।
বিশ্বজগৎ মণিভূষণ বিশ্লিষিত
চরণেÑ।”

নৃত্যটি মূলত দাঁড়াচ্ছে, আবর্তিত হচ্ছে গানকে কেন্দ্র করে। গানের কথার মধ্যে যে বক্তব্য ছুঁয়ে আছে তার ভিত্তিতেই নৃত্যের মুদ্রা রচিত হচ্ছে। ফলে নৃত্যটিকে শুধু শেখা নয়। গানকে শুধু ধারণ করা নয়, গানের মর্মবাণীকেও আত্মস্থ করতে হচ্ছে পলে পলে। এবং এ বিষয়ে বারবার তালিম গ্রহণের পর একজন শিল্পী যে সত্যকে তার অস্তিত্বে ধারণ করছে তার কোনো বিনাশ নেই। সে অমচোনীয়। এখানে উদ্ধৃত চরণে যে বার্তা কিংবা চিত্রকল্প রচিত হয়েছে তার বিস্তার এত ব্যাপক ও গভীর যা নিরন্তর চর্চার মধ্য দিয়ে আমাদের চিন্তার পরিধি অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। শিশুদের মনোচেতনায় নতুন আলো উদ্ভাসিত হয়। এখানে মহাগগনের কথা আছে-যার মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে স্রষ্টার অসীম মহিমা। আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে বিশ্বচরাচরে, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, নদী-বনভূমি, ফুল, পাখি এমনি অলংকার, মণিমুক্তোর মত যে ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বময়। তার চিত্র শুধু প্রকাশিতই হয়নি কবির সৃষ্টি ও নির্মাণে, শাশ্বত এই সত্যটি নানা মাত্রায় পল্লবিত হয়ে শিশুমনে আবির ছড়ায়, তাকে নানারূপে লাবণ্যময় করে তোলে। ক্রমে সেখানে চির সবুজেরই আবাস গড়ে ওঠে। যা থেকে মহিরূহ বা বটবৃক্ষের উদ্ভাস ঘটে।

বিশালত্বের মহিমা নিয়ে যখন নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি শিশু-মনোভূমি গড়ে ওঠে সেখানে আর কখনও কোনো সংকীর্ণতা কিংবা অন্ধকার স্থান করে নিতে পারে না। একজন শুদ্ধ মানুষ হিশেবে একজন মাঙ্গলিক মানুষ হিশেবে গড়ে ওঠার সবপথ তখন তার সমানে অবারিত। উন্মুক্ত। সে পথ পেরিয়ে সে যখন শৃঙ্গে আরোহণ করে তখন সকল অস্পৃশ্যতা, নিঁচুতা, কূপম-ূকতা আর সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসন থেকে সে থাকে অনেক দূরে অনেক উঁচুতে। সে তখন মানুষ থেকে মানবে, মানব থেকে মানবতায়-মানবিকতায় উত্তীর্ণ। অর্থ-বিত্তের সকল মোহ থেকে সে মুক্ত থাকে তার শ্রদ্ধাচারী মন নিয়ে। তার মধ্যে অর্জিত হয় মানুষ জীব ও প্রকৃতিকে ভালোবাসার এক অপার শক্তি।

কচিকাঁচার মেলা সফল একটি সামাজিক সংগঠন হিশেবে এ কাজটি করে আসছে আজ দীর্ঘ ষাট বছর ধরে। তাদের এ শ্রম আর অধ্যবসায় মিথ্যে হয়নি। হবেও না কোনোদিন। মেলার পরিচর্যায় এমনি করে সেসব শিশুরা গড়ে উঠছে যারা কেবল মানব সম্পদই নয়, সামাজিক সম্পদও বটে। এ অর্জন আমাদের জাতির জন্য, সমাজের জন্য পরিবারের জন্য এক বিরাট শক্তি। এক গভীর প্রেরণা। এর কোনো ক্ষয় নেই।

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে