আনিসুল হক
আমি যেমন আমার আব্বা-আম্মার কাছে চির ঋণী, যেমন আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের কাছে ঋণী, তেমনি আমার ঋণ কচি-কাঁচার মেলার কাছে। রংপুরে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলা। ১৯৭৮ সালে আমরা শুরু করি কচি-কাঁচার মেলা। আমি তখন পড়ি ক্লাস এইটে। আজাদ ভাই নামের একজন ছিলেন, তিনি এলেন রংপুরে, এর আগে তাঁরা ছিলেন কুড়িগ্রামে, সেখানে তাঁরা কচি-কাঁচার মেলা করতেন, তাঁর পিতা বদলি হয়ে এলেন রংপুরে। সঙ্গে করে আনলেন কচি-কাঁচার মেলার ধারণা। রংপুরে ধাপ কটকিপাড়ায় কচি-কাঁচার মেলার শাখা হলো। নাম কী হবে? বারী ভাই, মোহাম্মদ বারী, নাট্যজন, এখন ঢাকায় এবং মঞ্চ ও টেলিভিশনে অভিনয়ের কারণে বিখ্যাত, তখন পড়েন রংপুর জিলা স্কুলে, হয়তো মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে, ফল বেরয়নি, তিনিই নামকরণ করলেন, অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলা।
আর ছিলেন মোফাখখারুল ইসলাম, ডাকনাম লাভলু। আমার মেজভাই আশরাফুল হকও ছিলেন। সবাই মিলে করা হলো অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলা। কত কী যে আমরা করতাম কচি-কাঁচার মেলার হয়ে।
আমরা শিশু একাডেমির মৌসুমী প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। প্রথমবার ঢাকায় এলাম জারিগান, বিতর্ক, আর দেয়ালপত্রিকা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। প্রথমবার বোধহয় ঢাকায় আমরা পুরস্কার পাইনি। এরপরের বার থেকেই বিতর্কে আর দেয়াল পত্রিকায় পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হই। এমনকি জারিগানেও আমরা পুরস্কার পেয়েছিলাম। দেয়ালপত্রিকাটা আমিই লিখতাম, আমিই আঁকতাম। বর্ষা উপলক্ষে সব ছড়া কবিতা কার্টুন প্রবন্ধ লিখতে হতো। বিচারক থাকতেন হাশেম খান, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ।
আর আমি আমার বিতার্কিক দলকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতাম। প্রতিদিন আমরা একটা করে বিষয় ঠিক করে বিতর্ক করতাম। নিয়মিত বিতর্ক করে করে ছেলে-মেয়েরা পাকা হয়ে আসত। ঢাকায় এসে আমাদের দলের আশে-পাশেই কেউ দাঁড়াতে পারত না। ঢাকা থেকে রংপুর ফিরে গেলে জেলা প্রশাসক আমাদের সংবর্ধনা দিতেন।
তারপর লিখতে শুরু করলাম নাটক। দুটো নাটক লিখেছিলাম, একটার নাম, এক যে ছিল রাজা। ‘রাজা তোর কাপড় কই’ গল্পটাকে নাটক বানিয়েছিলাম। আর পরেরটা কাব্যনাট্য। সবুজ অবুঝ হাতছানি। দুটো নাটকই আমারই নির্দেশে মঞ্চস্থ করেছিল বাচ্চারা। একবার একটা প্রতিযোগিতায় সেই নাটক নিয়ে ঢাকাতে চলেও এসেছিলাম। জিততে পারিনি।
আমাদের বাচ্চারা সুন্দর গান করত, আবৃত্তি করত, পিটি প্যারেড করত। আলী মাসুদ পারভেজ মুরাদ গান শেখাতেন। তার বোনেরাও, সবাই ছোট ছোট, গান করত। একজন নাচত। আমাদের বাচ্চারা নিয়মিত আসত পিটিআইয়ের কোনো ক্লাস রুমে। আব্বা পিটিআইয়ের সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। কাজেই অনুমতি নিতে অসুবিধা হতো না। মুরাদ ভাই গান শেখাতেন। গোলাপ ভাই তবলা বাজাতেন। আমরা ভালো একজন নাচের শিক্ষকও পেয়েছিলাম।আমরা ফুটবল খেলতাম। ফুটবল টুর্নামেন্ট করতাম। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। দেয়াল পত্রিকা তো করতামই। ঢাকায় এসে আমরা দেখা করতাম দাদাভাইয়ের সঙ্গে। পুরানা পল্টনে কচি-কাঁচার মেলার অফিস। সেখানে যেতাম কোনো এক সন্ধ্যাবেলায়।আর একটা কাজ ছিল নিয়মিত কচি-কাঁচার আসরে খবর পাঠানো। যা যা অনুষ্ঠান হতো, তার খবর আর ছবি পাঠাতে হতো ঢাকায়। ইত্তেফাকে সেই সব খবর ছাপা হতো। সাধারণত আমিই খবরগুলো লিখতাম। লাভলু ভাই ছবি তুলতেন।তারপর বুয়েটে ভর্তি হয়ে ঢাকা চলে এলাম ১৯৮৪ সালে।
অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল হয়ে গেল।
ঢাকায় গিয়ে বসে থাকতাম দাদাভাইয়ের ইত্তেফাকের কক্ষে। তিনি আমাকে চিঠিপত্র ধরিয়ে দিতেন। বলতেন, বাছাই করো।
একদিন লিখতে দিলেন। পাখিদের ওপরে একটা ইংরেজি লেখা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা থেকে একটা ফিচার লেখো। আমি লিখলাম, ‘পাখিরা আছে বলে।’ সুন্দর করে ছাপা হলো কচি-কাঁচার আসরে।
তারপর একটা ছড়া লিখলাম।
রাত্রি আসে
শহর জুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে
চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে।
অনেক দূরে কমলাপুরে ট্রেনের বাঁশি,
বাসডিপোতে বৃদ্ধ বাসের হঠাৎ কাশি।
নিঝুম সড়ক কারফিউ দেয় পাহারা।
শহরটা কি মরুভূমি, সাহারা?
ছোট্ট খোকা স্বপ্ন বোনে খেয়ালে,
কী যেন কী হচ্ছে লেখা দেয়ালে।
দাদাভাইয়ের হাতে দিয়েছি, তিনি বললেন, ইস, তুমি একটু আগে এলে না কেন। আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিল একজন। প্রশ্ন করল, ছড়া আর কিশোর কবিতার পার্থক্য কী। তাকে তোমার লাইন দুটো দিয়ে বলতাম, এই হলো কবিতা-- শহর জুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে/ চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে।
তারপর একদিন কবিতা লিখে দিলাম দাদাভাইয়ের হাতে। দাদাভাই, আপনি তো বিশেষ সংখ্যা দেখেন ইত্তেফাকে। আমার একটা কবিতা ছাপুন না।
তিনি বললেন, বিশেষ সংখ্যায় লিখবেন বিশেষ কবিরা। তুমি তো নতুন কবি।
কয়েক মাস পরে ঠিকই আমার কবিতা প্রকাশ করলেন দাদাভাই।
ব্যস, আমার ভবিতব্য স্থির হয়ে গেল।
আমাকে আমার সহপাঠী বন্ধুরা বলে, কী ব্যাপার, তুমি যে লেখাপড়া ঠিকভাবে করছ না। করবেটা কী।
আমি বলি, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং করব না। কবিতা লিখব। আর কোনো একটা সংবাদপত্রে কাজ করব।
আমাকে নিয়ে দাদাভাই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বলতেন, তোমার একটা ভালো চাকরি দরকার। তুমি কী সাংবাদিকতা করছ!
তখন তো আমি সাপ্তাহিক কাগজে কাজ করতাম।
আমি ভোরের কাগজে যোগ দেওয়ার পরে দাদাভাই বললেন, বেতন ঠিকমতো হয়তো?
জি দাদাভাই।
কিন্তু তোমার ইঞ্জিনিয়ারিং করাই উচিত। আমি কি কাউকে বলে দেব?
না দাদাভাই।
আমি তো সাংবাদিকতা আর লেখালেখিতেই রয়ে গেলাম। একদিন দেখা বইমেলায়। আমি ছুটে গেলাম, দাদাভাই, আমার উপন্যাস বেরিয়েছে। খুব বিক্রি হচ্ছে।
দাদাভাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। বললেন, বই বিক্রি হওয়া ভালো কথা না। ভালো লেখকদের বই তো বেশি বিক্রি হয় না।
আমাদের সময়ে কচি কাঁচার মেলা ছিল। খেলাঘর ছিল। এখন তো আর এইসব সংগঠনের তেমন তোড়জোর নেই। সেটা ভালো লক্ষণ নয়। এই যে ছেলেমেয়েরা আদর্শহীনতার সংকটে ভুগছে, বড় স্বপ্ন দেখতে শিখছে না, দৌড়-ঝাঁপ খেলাধুলা করছে না, এ জন্য আমাদের শিশুদের কিশোরদের দায়ী করলে চলবে না। কচি কাঁচার মেলা, খেলাঘরের মতো সংগঠন চাই। চাই তাদের ব্যাপক কার্যক্রম।
দাদাভাইয়ের একটা স্বপ্ন ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য একটা রঙিন পত্রিকা বের করবেন। খুব চাইতেন, ইত্তেফাক হাউজ থেকে সেটা বের হোক। তখন তো ইত্তেফাকেরই একচেটিয়া জনপ্রিয়তা ছিল।
আজকে দাদাভাই নেই। আমরা একটা পত্রিকা বের করি। কিশোর আলো। রঙিন পত্রিকা। আমাদের স্লোগান--আমার পৃথিবী অনেক বড়। আমাদের পত্রিকাটা খুব জনপ্রিয় শিশুকিশোরদের মধ্যে।
তবু যেন মনে হয়, শুধু পত্রিকা করলেই হবে না, সংগঠন চাই। কচি-কাঁচার মেলা চাই। খেলাঘর চাই। মুকুল ফৌজ চাই। আমরা কি আবারও শিশুসংগঠনের সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারি না?
আমি যেমন আমার আব্বা-আম্মার কাছে চির ঋণী, যেমন আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের কাছে ঋণী, তেমনি আমার ঋণ কচি-কাঁচার মেলার কাছে। রংপুরে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলা। ১৯৭৮ সালে আমরা শুরু করি কচি-কাঁচার মেলা। আমি তখন পড়ি ক্লাস এইটে। আজাদ ভাই নামের একজন ছিলেন, তিনি এলেন রংপুরে, এর আগে তাঁরা ছিলেন কুড়িগ্রামে, সেখানে তাঁরা কচি-কাঁচার মেলা করতেন, তাঁর পিতা বদলি হয়ে এলেন রংপুরে। সঙ্গে করে আনলেন কচি-কাঁচার মেলার ধারণা। রংপুরে ধাপ কটকিপাড়ায় কচি-কাঁচার মেলার শাখা হলো। নাম কী হবে? বারী ভাই, মোহাম্মদ বারী, নাট্যজন, এখন ঢাকায় এবং মঞ্চ ও টেলিভিশনে অভিনয়ের কারণে বিখ্যাত, তখন পড়েন রংপুর জিলা স্কুলে, হয়তো মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে, ফল বেরয়নি, তিনিই নামকরণ করলেন, অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলা।
আর ছিলেন মোফাখখারুল ইসলাম, ডাকনাম লাভলু। আমার মেজভাই আশরাফুল হকও ছিলেন। সবাই মিলে করা হলো অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলা। কত কী যে আমরা করতাম কচি-কাঁচার মেলার হয়ে।
আমরা শিশু একাডেমির মৌসুমী প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। প্রথমবার ঢাকায় এলাম জারিগান, বিতর্ক, আর দেয়ালপত্রিকা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। প্রথমবার বোধহয় ঢাকায় আমরা পুরস্কার পাইনি। এরপরের বার থেকেই বিতর্কে আর দেয়াল পত্রিকায় পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হই। এমনকি জারিগানেও আমরা পুরস্কার পেয়েছিলাম। দেয়ালপত্রিকাটা আমিই লিখতাম, আমিই আঁকতাম। বর্ষা উপলক্ষে সব ছড়া কবিতা কার্টুন প্রবন্ধ লিখতে হতো। বিচারক থাকতেন হাশেম খান, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ।
আর আমি আমার বিতার্কিক দলকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতাম। প্রতিদিন আমরা একটা করে বিষয় ঠিক করে বিতর্ক করতাম। নিয়মিত বিতর্ক করে করে ছেলে-মেয়েরা পাকা হয়ে আসত। ঢাকায় এসে আমাদের দলের আশে-পাশেই কেউ দাঁড়াতে পারত না। ঢাকা থেকে রংপুর ফিরে গেলে জেলা প্রশাসক আমাদের সংবর্ধনা দিতেন।
তারপর লিখতে শুরু করলাম নাটক। দুটো নাটক লিখেছিলাম, একটার নাম, এক যে ছিল রাজা। ‘রাজা তোর কাপড় কই’ গল্পটাকে নাটক বানিয়েছিলাম। আর পরেরটা কাব্যনাট্য। সবুজ অবুঝ হাতছানি। দুটো নাটকই আমারই নির্দেশে মঞ্চস্থ করেছিল বাচ্চারা। একবার একটা প্রতিযোগিতায় সেই নাটক নিয়ে ঢাকাতে চলেও এসেছিলাম। জিততে পারিনি।
আমাদের বাচ্চারা সুন্দর গান করত, আবৃত্তি করত, পিটি প্যারেড করত। আলী মাসুদ পারভেজ মুরাদ গান শেখাতেন। তার বোনেরাও, সবাই ছোট ছোট, গান করত। একজন নাচত। আমাদের বাচ্চারা নিয়মিত আসত পিটিআইয়ের কোনো ক্লাস রুমে। আব্বা পিটিআইয়ের সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। কাজেই অনুমতি নিতে অসুবিধা হতো না। মুরাদ ভাই গান শেখাতেন। গোলাপ ভাই তবলা বাজাতেন। আমরা ভালো একজন নাচের শিক্ষকও পেয়েছিলাম।আমরা ফুটবল খেলতাম। ফুটবল টুর্নামেন্ট করতাম। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। দেয়াল পত্রিকা তো করতামই। ঢাকায় এসে আমরা দেখা করতাম দাদাভাইয়ের সঙ্গে। পুরানা পল্টনে কচি-কাঁচার মেলার অফিস। সেখানে যেতাম কোনো এক সন্ধ্যাবেলায়।আর একটা কাজ ছিল নিয়মিত কচি-কাঁচার আসরে খবর পাঠানো। যা যা অনুষ্ঠান হতো, তার খবর আর ছবি পাঠাতে হতো ঢাকায়। ইত্তেফাকে সেই সব খবর ছাপা হতো। সাধারণত আমিই খবরগুলো লিখতাম। লাভলু ভাই ছবি তুলতেন।তারপর বুয়েটে ভর্তি হয়ে ঢাকা চলে এলাম ১৯৮৪ সালে।
অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল হয়ে গেল।
ঢাকায় গিয়ে বসে থাকতাম দাদাভাইয়ের ইত্তেফাকের কক্ষে। তিনি আমাকে চিঠিপত্র ধরিয়ে দিতেন। বলতেন, বাছাই করো।
একদিন লিখতে দিলেন। পাখিদের ওপরে একটা ইংরেজি লেখা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা থেকে একটা ফিচার লেখো। আমি লিখলাম, ‘পাখিরা আছে বলে।’ সুন্দর করে ছাপা হলো কচি-কাঁচার আসরে।
তারপর একটা ছড়া লিখলাম।
রাত্রি আসে
শহর জুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে
চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে।
অনেক দূরে কমলাপুরে ট্রেনের বাঁশি,
বাসডিপোতে বৃদ্ধ বাসের হঠাৎ কাশি।
নিঝুম সড়ক কারফিউ দেয় পাহারা।
শহরটা কি মরুভূমি, সাহারা?
ছোট্ট খোকা স্বপ্ন বোনে খেয়ালে,
কী যেন কী হচ্ছে লেখা দেয়ালে।
দাদাভাইয়ের হাতে দিয়েছি, তিনি বললেন, ইস, তুমি একটু আগে এলে না কেন। আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিল একজন। প্রশ্ন করল, ছড়া আর কিশোর কবিতার পার্থক্য কী। তাকে তোমার লাইন দুটো দিয়ে বলতাম, এই হলো কবিতা-- শহর জুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে/ চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে।
তারপর একদিন কবিতা লিখে দিলাম দাদাভাইয়ের হাতে। দাদাভাই, আপনি তো বিশেষ সংখ্যা দেখেন ইত্তেফাকে। আমার একটা কবিতা ছাপুন না।
তিনি বললেন, বিশেষ সংখ্যায় লিখবেন বিশেষ কবিরা। তুমি তো নতুন কবি।
কয়েক মাস পরে ঠিকই আমার কবিতা প্রকাশ করলেন দাদাভাই।
ব্যস, আমার ভবিতব্য স্থির হয়ে গেল।
আমাকে আমার সহপাঠী বন্ধুরা বলে, কী ব্যাপার, তুমি যে লেখাপড়া ঠিকভাবে করছ না। করবেটা কী।
আমি বলি, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং করব না। কবিতা লিখব। আর কোনো একটা সংবাদপত্রে কাজ করব।
আমাকে নিয়ে দাদাভাই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বলতেন, তোমার একটা ভালো চাকরি দরকার। তুমি কী সাংবাদিকতা করছ!
তখন তো আমি সাপ্তাহিক কাগজে কাজ করতাম।
আমি ভোরের কাগজে যোগ দেওয়ার পরে দাদাভাই বললেন, বেতন ঠিকমতো হয়তো?
জি দাদাভাই।
কিন্তু তোমার ইঞ্জিনিয়ারিং করাই উচিত। আমি কি কাউকে বলে দেব?
না দাদাভাই।
আমি তো সাংবাদিকতা আর লেখালেখিতেই রয়ে গেলাম। একদিন দেখা বইমেলায়। আমি ছুটে গেলাম, দাদাভাই, আমার উপন্যাস বেরিয়েছে। খুব বিক্রি হচ্ছে।
দাদাভাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। বললেন, বই বিক্রি হওয়া ভালো কথা না। ভালো লেখকদের বই তো বেশি বিক্রি হয় না।
আমাদের সময়ে কচি কাঁচার মেলা ছিল। খেলাঘর ছিল। এখন তো আর এইসব সংগঠনের তেমন তোড়জোর নেই। সেটা ভালো লক্ষণ নয়। এই যে ছেলেমেয়েরা আদর্শহীনতার সংকটে ভুগছে, বড় স্বপ্ন দেখতে শিখছে না, দৌড়-ঝাঁপ খেলাধুলা করছে না, এ জন্য আমাদের শিশুদের কিশোরদের দায়ী করলে চলবে না। কচি কাঁচার মেলা, খেলাঘরের মতো সংগঠন চাই। চাই তাদের ব্যাপক কার্যক্রম।
দাদাভাইয়ের একটা স্বপ্ন ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য একটা রঙিন পত্রিকা বের করবেন। খুব চাইতেন, ইত্তেফাক হাউজ থেকে সেটা বের হোক। তখন তো ইত্তেফাকেরই একচেটিয়া জনপ্রিয়তা ছিল।
আজকে দাদাভাই নেই। আমরা একটা পত্রিকা বের করি। কিশোর আলো। রঙিন পত্রিকা। আমাদের স্লোগান--আমার পৃথিবী অনেক বড়। আমাদের পত্রিকাটা খুব জনপ্রিয় শিশুকিশোরদের মধ্যে।
তবু যেন মনে হয়, শুধু পত্রিকা করলেই হবে না, সংগঠন চাই। কচি-কাঁচার মেলা চাই। খেলাঘর চাই। মুকুল ফৌজ চাই। আমরা কি আবারও শিশুসংগঠনের সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারি না?
0 Comments