Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিস্তার এবং চিরায়ত প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা


                                                       ড: এ টি এম শামসুল হুদা

বর্তমান বছরের জুলাই মাসে পরপর সংঘঠিত দু’টি ভয়াবহ জঙ্গী ঘটনা সারা দেশকে শুধু শোকবিহ্বলই করেনি Ñ দীর্ঘকাল যাবৎ লালিত ধ্যানধারণাকেও প্রচ-ভাবে নাড়া দিয়েছে।

বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যে কখনও উগ্রবাদিতা, গোষ্ঠিগত বিদ্বেষ কিংবা একের প্রতি অন্যের ঘৃণা প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি। ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ প্রকট হলেও দেশের আপামর জনগনের মধ্যে একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সৌহর্দ্দ নিয়েই বাংলার জনগনের সামাজিক বন্ধনের ধারার সৃষ্টি হয়েছে। যা কমবেশী এখনও অব্যাহত রয়েছে।

সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার পর দেশ বিদেশে অনেক আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়েছে। এই বিশ্লেষণে, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে, দু’টি অপ্রিয় সত্য উন্মোচিত হয়েছে। এতদিন যাবৎ বিভিন্ন পর্যায়ে এমন একটা ধারণা পোষণ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদের কোন অবস্থান নেই Ñ ধর্মের নামে যে সমস্ত সন্ত্রাসী কর্মকা- বিচ্ছিন্নভাবে সংঘঠিত হচ্ছে তা স্থানীয় পর্যায়ের কিছু বিভ্রান্ত ও বিপমগামী ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘঠিত হচ্ছে। দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর বহু সন্তানের ভরণপোষন ও শিক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণের নামে এদের দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাছাই করে দেশের মক্তব-মাদ্রাসায় ভর্তির পর জঙ্গী মতাদর্শে দিক্ষীত করা হয়। একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এদের বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব তরুন মূলতঃ মাদ্রাসা প্রশিক্ষিত ও সমাজের অবহেলিত ও সুযোগসুবিধা বঞ্চিত গোষ্ঠীভুক্ত যারা ইসলামী উগ্রপন্থী মতাদর্শের মধ্যে তাদের হতাশা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেতে চায়।

ঘটনার নিবিড় বিশ্লেষণে দেখা যায় যে শুধুমাত্র দরিদ্র মাদ্রাসাভিত্তিক হতাশ তরুণরাই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সাথে জড়িত এটি অর্ধসত্য মাত্র। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদেরও সন্ত্রাসে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় Ñ এদের বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক জঙ্গী সংগঠনের সাথে যোগাযোগের ঘটনাও প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছে।

একটি জটিল পরিস্থিতির অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যে দু’টি বিষয় পরিস্কার হয়ে প্রতিভাত তা হলো Ñ জঙ্গীবাদ ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকেই সমভাবে আক্রান্ত করতে পারে। আর এই কর্মকা- এখন আর বাংলাদেশের ভৌগলিক চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বায়ন  প্রক্রিয়া আর প্রযুক্তির বদৌলতে এটি জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। ঐসব সংগঠনের কোন শাখা-উপশাখা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত না থাকলেও বহু সন্তান বিদেশে গিয়ে ঐসব উগ্রপন্থী সংগঠনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এদের কেউ কেউ এদের কাছ থেকে দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সেসব মতাদর্শ প্রচার ও প্রসারের চেষ্টা করে আসছে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উন্মোচিত বিষয়াদি দেশের সচেতন নাগরিকদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বচ্ছল পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানেরা কেন জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি কর্মকা-ে এতটাই আত্মনিবেদিত হলো যে তারা নির্দ্বিধায় ও নির্বিচারে নিরপরাধ ব্যক্তিদের নৃশংশভাবে হত্যা করে বাংলাদেশে বর্বরতার এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলো। বাংলাদেশের মূল ধারার সামাজিক রীতি-নীতিতে কি এমন বাড়াবাড়ী কিংবা ঘাটতি আছে যা তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এসমস্ত তরুনের জীবন গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকা-ে কোথায় কি অসম্পূর্ণতা, বৈপরীত্য কিংবা শুন্যতা আছে যে কারণে তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এক ভয়াবহ বিকল্পের দিকে ঝুঁকে পড়েছে?

এসব প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্ত এর সঠিক কোন উত্তর নেই। আমরা যখনই কোন জটিল সমস্যার সম্মুখিন হই আমাদের প্রবণতা হলো সমস্যার গভীরে না গিয়ে আপাতকালীন কিছু ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যাটিকে ধামাচাপা দেয়া। জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করতে হলে আমাদের সমস্যার গভীরে গিয়ে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক কৌশল নির্ধারণ এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে।

সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনাসমূহের প্রেক্ষিতে কচি-কাঁচার মেলার মত সংগঠনের কি ভূমিকা ছিল এবং থাকা বাঞ্চনীয় বর্তমান আলোচনা এই আঙ্গিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এ প্রসঙ্গে সীমিত কিছু পর্যবেক্ষণ যথাযথ মনে হয়। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত সামাজিক বন্ধন ও সৌহার্দের অন্যতম বাহন পরিবার, শিক্ষাঙ্গণ এবং শিশু-কিশোর এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন। এরা বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।

বিগত কয়েক দশকে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নবনব সৃষ্টি ও উদ্ভাবন এবং সারাবিশ্বে এর দ্রুত প্রসার ও প্রবৃদ্ধি সারাবিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন মানুষের সার্বিক মঙ্গলের জন্য Ñ তবে সকল দেশে এবং সবার জন্য এই প্রক্রিয়া শুভ না হয়ে আরও জটিল ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বায়নের তোড়ে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে দ্রুত আর্থিক সম্মৃদ্ধি অর্জনের প্রতিযোগিতায় তরুনদের জীবন গঠনে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিশু কিশোর সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা দুর্বল ও গৌণ হয়ে পড়েছে। ধনতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যেমন দেশে বৈষম্যের হার ও পরিমান অনাকাঙ্খিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি পুরাতন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে পাশ কাটিয়ে নূতন নূতন প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বহুবিধ আর্থসামাজিক দ্বৈততার সৃষ্টি করেছে। এই দ্বন্দ থেকেই সমাজে বৈষম্য, হতাশা, বিদ্বেষ আর ঘৃণার বীজ রোপিত হয়েছে যা কালে কালে পরিপক্ক হয়ে ভয়াবহ রূপে প্রকাশ পেয়েছে।

সামাজিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন উদ্ভূত পরিবর্তনের ফলে সনাতন প্রতিষ্ঠানÑ পরিবার, শিক্ষাঙ্গন আর অন্যান্য সহায়ক সংগঠন কাঙ্খিত হারে তাদের সেবা প্রদানে আর সক্ষম নয়। সেখানে এক ধরনের শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের তরুনরা সামনে চলার পথে অনেকেই বিভ্রান্ত এবং হতাশ হয়ে পড়েছে। এই শুন্যতার সুযোগে উগ্রবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহ ইসলামের অপব্যাখ্যা এবং অনেক চমক সৃষ্টিকারী প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করে বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্থ তরুনদের কাছে একটি আকর্ষনীয় বিকল্প সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আমাদের এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে কিভাবে আমরা কচি-কাঁচার মেলার মতো সহায়ক সংগঠনগুলোকে আবার আগের চাইতে আরও অনেক গতিশীল ও সক্ষম করে তরুণদের দেশের সুনাগরিক হওয়ার পথ সুগম করতে পারি।

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে