-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
সকল পেশা এবং সকল কর্মে নিয়োজিত প্রতিটি মানুষকে সক্রিয় অংশীদারিত্বে নিয়ে আসতে পারলে ‘ইনক্লুসিভ সোসাইটি’ বা সকলের অংশীদারিত্বের সমাজ গড়ে ওঠে। সমাজ সংহত হয়। শক্তিশালী হয়। আধুনিক গনতন্ত্রিক সমাজগঠনের এটাই মূল লক্ষ্য। ইনক্লুসিভ সমাজে প্রতি ব্যক্তিই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং দায়িত্বপালনে সক্রিয়। প্রত্যেকে অধিকার সচেতন। নিজের অধিকার এবং অন্যের অধিকার। নিজের অধিকার চর্চায় যেমন সক্রিয়, তেমনি অন্যের অধিকার সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ। গনতান্ত্রিক সমাজের এমন চুড়ান্ত এবং আদর্শ রূপ এখনো কোনদেশে গড়ে ওঠেনি। তবে গনতান্ত্রিক উন্নত সমাজসমুহের এটাই লক্ষ্য এবং সে লক্ষ্যেই ধাবমান হচ্ছে তারা। অগ্রসরমান ও বটে।
আমাদের সমাজ এখনো সংহত হয়নি। তবে অগ্রসরমান। আমাদের সমাজে একটি elite class। তারাই সমাজ চালায়। তারাই দৃশ্যমান। অন্যটি delete class। তারা ‘ভুলক্রমে’ জন্মগ্রহণ করে। অবহেলিতভাবে জীবন যাপন করে। মৃত্যুর সাথে সাথে মুছে যায় তাদের স্মৃতি। এক সময়ে রাজা-বাদশারা ছিল এলিট শ্রেনী। ভালো বা মন্দ অক্ষরে ইতিহাসে তাদের নাম লেখা রয়েছে। অগুনিত জনতার কথা ইতিহাসে নেই। তারা মুছে গেছে। এখন মিলিওনিয়ার্স এবং বিলিওনিয়ার্সের যুগ। সদম্ভে তাদের বিচরন। সাধারণ মানুষ বিস্মৃত।
তথ্যবিপ্লবের অগ্রযাত্রায় যেন সমাজ বির্বতনের পালে হাওয়া লেগেছে। একসময়ে পাঠ্যবইতে পড়তাম, এদেশের শতকরা আশিভাগ মানুষ কৃষিজীবি। বর্তমানে এই হার নেমে দাঁড়িয়েছে ত্রিশের ওপর। মোটামুটি এক তৃতীয়ংশ মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত। তাই বলে কিন্তু কৃষিজীবির সংখ্যা কমেনি। বরং বেড়েছে। যখন ৮০% মানুষ কৃষিজীবি ছিলেন, তখন জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি। সে হিসাবে কৃষিজীবির সংখ্যা ছিল ৪ কোটি। এখন জনসংখ্যা কমবেশী ১৫ কোটি। এর এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৫ কোটি মানুষ কৃষিজীবি। সমাজে এতগুলো মানুষের অবস্থান কোথায়? তাদের অবদানই বা কতখানি।
পাঁচকোটি কৃষকের অবদান কিন্তু অসামান্য। ষাটের দশকে পূর্ববাংলার খাদ্যচাহিদার অর্ধেকটা উৎপাদন হতো এখানে। বাকীটা আসতো বিদেশ থেকে। একাত্তরের সাড়ে সাতকোটি মানুষ বেড়ে এখনো দ্বিগুন হয়েছে। পনের কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এখন কৃষকেরা পনেরো কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করছে। বিশাল এ অবদানের স্বীকৃতি কি তারা পেয়েছে? পনের কোটি মানুষকে যারা খাওয়াচ্ছে, তাদের দুবেলা অন্ন জুটছে কি? তারা স্বাস্থ্যসম্মত একটি বাড়ীতে বসবাস করছে কি? দৃষ্টি নন্দন না হোক, ভদ্রসম্মত পোষাক তারা পরতে পারছে কি? অসুখ হলে চিকিৎসা পাচ্ছে কি? ভোটের সময় ছাড়া অন্য সময়ে সমাজপতিরা তাদের খোজ খবর রাখেন কি?
ইনক্লুসিভ সমাজ গড়ে না উঠলে, এসব হবে ও না । কৃষকেরা delete শ্রেনীতেই থাকবেন। তবু চলমান সমাজে স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতেই হবে। স্থবিরতা কাটানোর আন্দোলনে কৃষকের পাশে অকৃষক ও দাঁড়াতে পারেন। দাঁড়িয়েছেন ও। কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন তথা সমাজ বিবর্তনের ক্যাটালিষ্ট বা সংঘটক হিসাবে আমরা কিছু কিছু প্রয়াসকে সনাক্ত করতে পারি।
হারানো দিনের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখতে পাই তথ্যাভাবে কৃষকের ভোগান্তি। সারের প্রচলন হয়েছে, কিন্তু কোন সার কখন, কিসের জন্য এবং কি পরিমান ব্যবহার করতে হবে, কৃষক জানে না। পোকার আক্রমন হয়েছে, কি ওষুধ দিতে হবে জানা নেই। এমনি কতরকম তথ্যাভাব। তখন মিডিয়া বলতে ছিল শুধু বেতার। মাটি ও মানুষের পাশে দাড়ালেন শাইখ সিরাজ। বেতারের কৃষি অনুষ্ঠানে তাঁর বাস্তবসম্মত পরামর্শ ও কৃষি তথ্য সরবরাহের ফলে, এটি হয়ে উঠলো কৃষকের অনুষ্ঠান। পল্লী এলাকায় বেতারের কৃষি অনুষ্ঠানটি যে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তার মূলেই ছিলেন শাইখ সিরাজ।
সময়ের বিবর্তনে, প্রযুক্তির অবদানে কথার সাথে যুক্ত হলো ছবি। শুরু হলো টেলিভিশন সম্প্রচার। অত্যন্ত বলিষ্ঠ মাধ্যম। দীর্ঘদিন সরকারি টেলিভিশন চলার পর তার সাথী হয়ে এলো বেসরকারি চ্যানেল। বিগত শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে জন্ম নিল চ্যানেল-আই। ইংরেজী ‘আই’ শব্দটির দুটো অর্থ। একটি অর্থ ‘আমি’ অন্যটি ‘চোখ’। আমি শব্দটি স্মরণ করিয়ে দেয় ইনক্লুসিভ সমাজের কথা। ‘আমি’ সমাজের একজন। আমাকে বাদ দিয়ে সমাজ নয়। ‘চোখ কথাটি ইঙ্গিত করে দর্শনপ্রক্রিয়ার দিকে। যে চোখ দিয়ে সমাজকে পরখ করা যায়। ‘চ্যানেল-আই’ এর লোগোতে লেখা রয়েছে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ। ‘চ্যানেল-আই’ এর যে প্রতীকি ‘আমি’, তার হৃদয়ে বাংলাদেশ’। ‘চ্যানেল-আই’ এর যে প্রতীকি ‘চোখ’-সে চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ মানষ কৃষিজীবি। কৃষি ও কৃষককে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না। তাই ‘চ্যানেল-আই’ এর প্রোগ্রামে স্থান করে নিল কৃষি। কৃষি প্রোগ্রামের পরিকল্পনা, পরিচালনা ও উপস্থপনায় এবারে ও হাজির হলেন বেতারের সেই শাইখ সিরাজ।
বাংলাদেশের ইলেট্টনিক মিডিয়ায় প্রধান সংবাদ পরিবেশনায় কৃষি সংবাদের স্থান পাওয়া ছিল একটি সাহসী পদক্ষেপ। প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদপত্রে যেখানে কৃষি আর কৃষকের কভারেজ যৎসামান্য, সেখানে আধুনিক আকাশ মিডিয়ায় কৃষি প্রোগ্রামের এমন বলিষ্ঠ উপস্থিতি ছিল চমকপ্রদ। শুরুতে পল্লীর কৃষক গৃহে টেলিভিশন ছিল না। তবু তাদের কথা উপস্থাপন করার মধ্যে একটি কমিটমেন্ট ফুটে উঠেছিল। delete দের elite কাতারে নিয়ে আসার কষ্টসংগ্রামের সাথী হবার সংকল্পই যেন প্রকাশ করছিল চ্যানেল-আই। আগামীর ইনক্লুসিভ সমাজ বিনির্মানে “চ্যানেল-আই” এর এই সাহসী ভূমিকা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
‘চ্যানেল-আই’ এর ক্যামেরায় প্রতিদিন ধারন করা হচ্ছে কৃষকের কথা, কৃষকের সমস্যা, কৃষকের সম্ভাবনা, কৃষকের হাসিকান্না। গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব ধারন করছেন শাইখ সিরাজ। কৃষি সংবাদ ছাড়া ও বিকেলের অনুষ্ঠানমালায় থাকে কৃষি বিষয়ক প্রচার।
শুধু কৃষি সংবাদ বা কৃষি তথ্য প্রচারই নয়। ‘চ্যানেল-আই’ যেন হয়ে উঠেছে কৃষকের মঞ্চ। কৃষকের পর্বতপ্রমান অবদান রয়েছে খাদ্যঘাটতি পূরণে, কৃষকের সাফল্য রয়েছে দেশের অর্থনীতির চক্রঘুর্ননে। অথচ কৃষকের নিজস্ব মঞ্চ নেই নিজেকে উপস্থাপনার। ‘চ্যানেল-আই’ সেই মঞ্চ তৈরী করে দিয়েছে কৃষকের সমাজ সম্পৃক্তকরনের প্রক্রিয়ায়। ‘চ্যানেল-আই’ সম্প্রচার চ্যানেলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইনক্লুসিভ সমাজ বিনির্মানে ক্যটালিষ্টের যে সাহসী এবং সৃজনশীল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ‘চ্যানেল-আই’ এর কৃষি মঞ্চকে ভিত্তি করে এর রূপকার শাইখ সিরাজ ধীরে ধীরে নিজেকে কৃষকের প্রতিনিধি হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন। কৃষকদের কভারেজ দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হন নাই। জাতীয় বাজেটে কৃষকের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বিগত কয়েক বছর ধরে। কৃষক সভায় মতামত/বক্তব্য ধারণ করে এনে প্রতিবছর কৃষিবাজেটের সুপারিশমালা রচনা করছেন। এর প্রতিচ্ছবি জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। ‘চ্যানেল-আই’ এর মঞ্চ এবং শাইখ সিরাজের প্রচেষ্টার সমন্বয়ে কৃষক ধীরে ধীরে উঠে আসছে সমাজের মূল আঙ্গিনায়। চ্যানেল-আই আর শাইখ সিরাজ যেন একীভূত হয়ে গেছেন একটি সামাজিক কমিটমেন্টের বাস্তবায়নে। উভয়কে সাধুবাদ।
0 Comments