রাশিদুল হাসান জুনায়েদ
১৯ জুলাই ২০১৮ কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার সভাপতি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, মেলার উপদেষ্টা এবং ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য খোন্দকার মোঃ আসাদুজ্জামান, উপদেষ্টা বদরুল আলম, রুমি আপু, পিয়াল, জান্নাত আর আমিÑআমরা সাতজন গিয়েছিলাম উল্লাপাড়া বাচিক কর্মশালায়। আমার জন্য এই সফরে অপেক্ষা করছিল বেশকিছু নতুন অভিজ্ঞতা।
বাচিক কর্মশালায় যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। মেলার সভাপতি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, মেলার উপদেষ্টা খোন্দকার মো.আসাদুজ্জামান, মেলার উপদেষ্টা বদরুল আলম এবং বিশিষ্ট আবৃত্তিকার রূপা চক্রবর্তী (রূপাদিরও আমাদের সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল; রূপাদি কোন জরুরিকাজে আটকে পড়ায় যেতে পারেননি) আমাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন কীভাবে বাচিক কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমি আর রুমি আপু সহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে গিয়েছিলাম এই কর্মশালায় আর এইজন্যই বলেছিলাম নতুন অভিজ্ঞতা, অভাবনীয়ও বলা যায়। আমি একটু বেশি বেশি বলছি বলে মনে হতে পারে কিন্তু আরও একটু শোনার পর আর মনে হবে না। ভাল কথাÑজান্নাত আর পিয়ালের কথা বলা হল না। জান্নাত শিক্ষার্থী হিসেবে কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছে আর পিয়াল আমাদের এই সফরকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে ফটোগ্রাফার হিসেবে ছিল (সে ফটোগ্রাফার ভালই)।
বদরুল ভাইয়াকে একটি বিশেষ ধন্যবাদ দেওয়া বাকি আছে। তিনি তার ভীষণ ব্যস্ত রুটিনের মধ্যেও আমাকে আর রুমি আপুকে যতœ করে শিখেয়েছেন কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করব উল্লাপাড়া মেলায়, ভাই-বোনদের কীভাবে কী কী শেখাব। প্রস্তুতিপর্ব শেষ, এবারে আমাদের যাত্রা হল শুরু। সত্যকথা বলতে আমার বাঁধভাঙ্গা উৎসাহ ছিল। আমরা রওনা দিয়েছিলাম সকাল ৭ টায়। উল্লাপাড়া পৌঁছালাম বেলা ১২ টায়। ঢুকেই আমি বিস্মিত বলা যায়। রাস্তার পাশে দেয়ালে কোন পোস্টার নেই। রাস্তায় কোন ময়লা-আবর্জনা নেই। এই দৃশ্য আমার জন্য অভাবনীয়। ঢাকা শহরে পরিষ্কার রাস্তাঘাট বেশ কমই চোখে পড়ে। যে হলরুমে কর্মশালার মূল আয়োজন সেই কক্ষে প্রবেশ করে দেখলাম ১০০’র বেশি ভাই-বোন উৎসাহী চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম। বেশ কয়েকজন ভাই-বোন আমাদের গান গেয়ে স্বাগত জানাল। প্রচ- গরম লাগছিল কিন্তু ওদের গান শুনে মুহুর্তের জন্য প্রশান্তি অনুভব করলাম। আমরা কর্মশালা উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে, দুপুরের খাওয়া দাওয়া করলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে শুরু হল আমাদের কর্মশালার মূলপর্ব। রিমঝিম কচি-কাঁচার মেলার ভাই-বোনেরা এত মেধাবীÑ কর্মশালায় আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম তাঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। বাঙলা ব্যাকরণ সম্বন্ধে কয়েকজনের ধারণা এত পরিষ্কার যে, তাদের বাচিক কর্মশালায় কোন একটি বিষয় বুঝাতে বেগ পেতে হয়নি।
প্রথম দিন বদরুল ভাইয়াই ক্লাস নিয়েছেন। দ্বিতীয় দিন ক্লাস নিয়েছিলাম আমি। শুরুতে কিছুটা ভীতি কাজ করলেও কয়েক সেকেন্ড লাগল বেরিয়ে আসতে। এরপর দারুণ আনন্দ হল। মনে হচ্ছিল না তেমন কঠিন কিছু করছি। আর বদরুল ভাইয়া আমি যেই সময়টা ক্লাস নিয়েছি তার পুরাটা সময় তিনি এক মিনিটের জন্যও বসেননি। আমি শিখিয়ে যাচ্ছি অ-এর ব্যবহার আর বদরুল ভাইয়া বোর্ডে উদাহরণ লিখে দিচ্ছেন। মাঝে-মধ্যে তিনিও মাইক্রোফোনে কিছু কথা বলে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে সাহায্য করেছেন। আর সামনে বসা একশত জনেরও বেশি শিক্ষার্থী। পেছনের ছোট্টমঞ্চে খালেদ ভাইয়া, আসাদুজ্জামান ভাইয়া বসে আছেন। এমন মানুষদের সামনে এত সহজে নিজের মতো করে ক্লাস নিতে পেরেছি, আমার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব তাঁদেরই। রুমি আপুকে জিজ্ঞাসা করা হলে ওর অনুভূতিও এমনটাই হবে আমি নিশ্চিত। শেষদিন আমরা একফাঁকে একটু ঘুরে এসেছিলাম।
উল্লাপাড়ার আপ্যায়নের কথা বলা হয়নি। ইতোমধ্যে বলা হয়ে গেছে উল্লাপাড়া কতটা সুন্দর;তাই নতুন করে কিছু বলছি না। যে কয়টি দিন সেখানে থেকেছি একটি বারের জন্যও মনে হয়নি আশেপাশের মানুষগুলো আমার নতুন চেনা। উল্লাপাড়া মেলার পরিচালক শাহাদাত হোসেন, আমার শাহাদাত আঙ্কেল, আমি তাঁকে স্থির হয়ে কয়েক মিনিট বসে থাকতে খুব কমই দেখেছি। আমাদের কখন কোনটা লাগছে, কোন সমস্যা হচ্ছে কি না-সবকিছু তদারকি করছেন। আমরা যখন খেতে বসতাম মাইসার আম্মুআন্টি, রোদেলার আম্মুআন্টি আরও একজন আন্টি ছিলেন নাম মনে করতে পারছি না আমাদের এত আপ্যায়ন করেছেন, যা মনে থাকবে অনেকদিন। ছোটবাচ্চাদের যেভাবে আদর করে খাওয়ানো হয় ঠিক সেভাবেই আদর করে খাইয়েছেন বলতে হবে। উল্লাপাড়ার খাবারের এত স্বাদ বিশেষকরে মাছের ভর্তা এখনও জিভে লেগে আছে। রান্নাবান্না আন্টিরাই করেছেন। উল্লাপাড়ার ঘোল খেয়েছিলাম। এর স্বাদ বলে বোঝানো অসম্ভব।
আমার জন্য এককথায় রোমাঞ্চকর এ সফরের শেষ দিন ২১ জুলাই আমাদের কর্মশালা যখন শেষÑ এক ঝাঁক ভাই বোন আমাদের ঘিরে ধরল।
অটোগ্রাফের জন্য। আমি একটা বাঁধভাঙ্গা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করছিলাম। ওরা আমাদের সবার কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছে। তবে আমি আমার কথা বলি। আমার জন্য ব্যাপারটা অভূতপূর্ব; তাই হয়তো আমি বেশি শিহরিত। আমি কিছু উপহারও পেলাম। যাইহোক, আমি সবাইকে কথা দিয়েছিলাম যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে আরও একবার দেখা করে যাব। কিন্তু সময় স্বল্পতায় সেটি আর সম্ভব ছিল না। উল্লাপাড়া গিয়েছিলাম বাচিক কর্মশালায় প্রশিক্ষক সহকারী হিসেবে কিছু দিয়ে আসতে। কিন্তু ফিরে আসার সময় নিয়ে এলাম কয়েকজন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তিনদিন প্রচ- গরম ছিল। আমরা ফিরে আসার দিন চারদিক হঠাৎ ঠা-া আকাশে মেঘ আর মৃদু বৃষ্টি। আমাদের মনের অবস্থা আর প্রকৃতি মিলে একাকার। এরই মধ্যে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী একবোন আয়েশা ফোন করল জান্নাতের মোবাইলে, কাঁদছে। জান্নাতেরও চোখের পানি। আমি, রুমি আপু প্রত্যেকেই কিছুটা বিমর্ষ। আসাদুজ্জামান ভাইয়া বললেন,‘এই যে তুমি একটা জায়গায় নতুন গেলে কাউকে চিনতে না অথচ একজন আরেকজনের জন্য কাঁদছÑএটাই তো প্রাপ্তি।’
এখনও আমি সুযোগের অপেক্ষায় আছি। আবার সুযোগ পেলেই চলে যাব উল্লাপাড়ায়।
0 Comments