-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটি দ্বারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার ভিত্তি প্রদান করা হয়েছে। জিয়া-মুশতাক জোট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল দু’টি মৌলিক পরিবর্তনের জন্য। প্রথমটি ছিল পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন অথবা নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন এবং দ্বিতীয়টি ছিল সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার থেকে বেরিয়ে আসা। প্রথমটি নিয়ে বিশাদ আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশ-ভারত পচিশ বছর চুক্তির আওতায় ‘বাংলাদেশে বিদেশী সেনার উপস্থিতির ঘটনা ঘটলে ভারতীয় বাহিনীর স্বেচ্ছায় পূনঃঅনুপ্রবেশে বাধা থাকবে না’ এমন ধারনার কারনে জিয়া-মুশতাকের সাহসে ভাটা পড়েছিল। দ্বিতীয় পরিবর্তন অর্থাৎ সমাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার মূলে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশী করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কট্টর ধনতন্ত্রে বিশ^সী, যা সমাজতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। কট্টর ধনতন্ত্রে রাষ্ট্রের সম্পদের বড় অংশ স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত থাকে এবং সম্পদের সুষম বন্টনে রাষ্ট্র নিস্ক্রিয় থাকে। ফলশ্রুতিতে ধনিকশ্রেনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, বারাক ওবামার মত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে ও স্বাস্থ্যবিল নিয়ে ধনিকশ্রেণীর সাথে সমঝোতা করতে হয়েছিল।
ধনতন্ত্রের বিপরিতে সমাজতন্ত্রের অবস্থান সম্পূর্ন ভিন্ন। সমাজতন্ত্রের প্রকারভেদ রয়েছে। কট্টর সমাজতন্ত্র বলতে কম্যুনিজম বোঝায়, যেখানে সকল সম্পদ রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকে এবং রাষ্ট্র বাজার নিয়ন্ত্রন করে। কট্টর কম্যুনিজম এখন দৃশ্যমান নয়। কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রগুলি বর্তমানে কমুনিষ্ট পার্টি শাসিত বাজারমুখী মিশ্র অর্থনীতির দেশ। ‘কট্টর সমাজতন্ত্র’ এবং ‘কম্যুনিষ্ট শাসিত মিশ্র অর্থনীতির সমাজতন্ত্র’ ব্যতিরেকে আরও একধরনের সমাজতন্ত্র এখন দৃশ্যমান, যা ‘কল্যান অর্থনীতি’ নামে পরিচিত। কল্যান অর্থনীতির ধারক রাষ্ট্র ‘কল্যান রাষ্ট্র’ বা ‘ওয়েলফেয়ার ষ্টেট’ নামে পরিচিত। বিলেতের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা স্যার উইলিয়াম বেভারিজ সর্বপ্রথম কল্যান রাষ্ট্রের ধারনা নিজ দেশে প্রয়োগ করেন। বেকারভাতা সহ দারিদ্র-সহায়ক অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য হয়ে ওঠে আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার ষ্টেট হিসাবে। কল্যান রাষ্ট্রে বাজেটের বিরাট অংশ ব্যয় হয় জনকল্যানে। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা জনগণের অধিকার। রাষ্ট্র এসব খাতে সহায়তায় দায়বদ্ধ। বর্তমান বিশে^ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কল্যান অর্থনীতি বা অধুনিক সমাজতন্ত্রের দেশ হল ইউরোপের সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক প্রভৃতি রাষ্ট্র। এমন কি জার্মানী ও কল্যান রাষ্ট্রের ভূমিকায় অগ্রগামী। তবে যুক্তরাজ্য গত কয়েক দশকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সুইডেন সারাবিশে^ কল্যান অর্থনীতির মডেল রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। সুইডেনে বহুদলীয় গণতন্ত্র সংহত, বাজার অর্থনীতি ও শক্তিশালী। সেই সাথে কল্যান অর্থনীতির প্রতি রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক ভাবেই সরকার ক্ষমতাবান। বাস্তবায়ন ব্যবস্থা ‘কঠোর’ সুশাসনের দ্বারা নিশ্চিত।
বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, “আমাদের রাষেট্রর অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” এই প্রস্তাবনার সাথে সংগতি রেখে সংবিধানের ৮(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের জন্য ‘সমাজতন্ত্র’ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বলে পরিগনিত হবে।
সমাজতন্ত্রের প্রয়োগিক নির্দেশনা দিয়ে সংবিধানের ১৮(২) ধারায় বর্ণিত হয়েছে, “মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”
কট্টর কম্যুনিজম সমাজতন্ত্রে সকল সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে থাকে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের একক মালিকানা থাকে না এবং ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত থাকে। এই বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩ধারায় বলা হয়েছে যে, “উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বন্টন প্রনালী সমুহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা ব্যবস্থা নি¤œরূপ হইবেঃ (ক) রাষ্ট্রের মালিকানা ....(খ) সমবায়ী মালিকানা.... এবং (গ) ব্যক্তি মালিকানা....।” সংবিধানের ১৪ ধারায় বর্ণিত হয়েছে “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমুহকে সকল প্রকার শোষন হইতে মুক্তি দান করা।”
সংবিধানের উদ্ধৃতি সমুহ থেকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিমালা সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট এবং স্বচ্ছ ধারনা পওয়া গেল। এই অর্থনৈর্তিক নীতিমালা যেহেতু সংবিধান নির্দেশিত, সেইহেতু এর বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বর্তমানে সরকার কর্তৃক অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতিমালা, কৌশলাদী ও কার্যাবলী সংবিধানে নির্ধারিত অর্থনৈতিক নীতিমালার সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কতটা সাংঘর্ষিক, তা বিশ্লেষনের দাবী রাখে।
পচাত্তরের অস্থিরতার পর সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির রাজনৈতিক পুনরুত্থান লক্ষ্য করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পুনরায় পরাজিত হতে শুরু করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তি প্রদান করার মত কঠিন কাজে সফলতা এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাকিস্তানীদের সহায়ক অপশক্তি দেশে সন্ত্রাস ও বিভাজনের যে অপকৌশল অবলম্বন করেছিল, তাও অনেকটাই থমকে গেছে। ৬৪ জেলায় একসাথে বোমা বিস্ফোরন; অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া, বৃটিশ রাষ্ট্রদূত, বিচারকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপর হামলা ও হত্যা, গীর্জাসহ ধর্মীয় স্থানে বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা, রমনায় বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরন প্রচেষ্টা এবং ২১শে আগষ্ট গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের শন্তিসমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে হামলায় নৃশংস হত্যা ও রক্তপাতের মত ভয়াবহ ঘটনা এখন আর ঘটছে না। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পুরুত্থান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেকটাই সক্ষম হয়েছে, একথা বলা চলে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক অঙ্গীকার অসাম্প্রদায়িক এবং শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ বিনির্মানে কিছুটা সাফল্য অর্জিত হয়েছে। যদি ও চলার পথ এখনো সম্পূর্ণ মসৃন হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নীতিমালা পূনরুদ্ধারে সফলতার সাথে সাথে অর্থনৈতিক নীতিমালা পূনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা রয়েছে কি না অথবা সাফল্য অর্জিত হয়েছে কিনা, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক নীতিমালা রাষ্ট্রের সংবিধানেই সন্নিবেশিত রয়েছে। লেখার শুরুতেই তা উল্লেখ করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি নির্ধারনী বক্তৃতা সমুহে তিনি তাঁর ভাষায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মূলনীতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি বিষয়ক বক্তব্যসমুহ স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৭২ সালের এক নীতি নির্ধারনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক বৈষম্য থাকবে না, মানুষে মানুষে আয় ও সম্পদ বৈষম্য থাকবে না, অঞ্চলে অঞ্চলে উন্নয়ন বৈষম্য থাকবে না।’ তাঁর আরেকটি প্রসিদ্ধ বক্তব্য ছিল ‘বিশ^ দুইভাবে বিভক্ত। শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এ ধরনের বেশ কিছু বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি শোষনহীন, নূন্যতম আয়-সম্পদ বৈষম্য এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ব্যবস্থাকেই সোনার বাংলা বলেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ তারাই যারা নাগরিকদের সক্রিয় রাষ্ট্রপরিচালায় বিশ^াস করে এবং জনগনের মধ্যে আয়-সম্পদের বৈষম্য-হ্রাস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যকে কেন্দ্র করেই ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, এগারো দফা, উনসত্তরের গণ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। তাই সঙ্গতকারনেই স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু সামাজিক জাগরন তথা পূন র্গঠনের ডাক দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের রক্ত¯œাত সংবিধানেও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তির নির্দেশনা রয়েছে। এটি একটি বিপ্লবের আকাঙ্খা। জাতির জনক তাই দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন। দেশ বিরোধীরা ‘বাকশাল’ নিয়ে অপব্যখ্যা দিল, হাসিঠাট্টা করলো কৃষক-শ্রমিকদের অপদস্থ করার জন্য, তাদের ক্ষমতায়নে ইতি টানতে। আসলে বাকশাল ছিল কৃষক-শ্রমিক তথা সর্বসাধারণের জন্য, সর্বসাধারনকে নিয়ে এবং সর্বসাধারণের দ্বারা সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বত্মক (Inclusive) উন্নয়ন। প্রতিক্রিয়াশীল এবং কট্টর পূঁজিপতি শক্তিমান বিদেশীদের অর্থ যোগসাজসে সফল হয়েছিল। বিজয়ের পর সাধারন জনগণ আবার পরাজিত হয়েছিল।
এখন অবস্থা এমনটাই দাঁড়িয়েছে যে, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রেখে বাংলাদেশ বিরোধীচক্র ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক অবস্থান গড়ে তুলেছে। একবার শতকোটি টাকার মালিক হলে, সে ধীরে ধীরে বিলিয়োনিয়ার হবে। একজন মার্কিন ধনিক-লেখক লিখেছিলেন প্রথম পঞ্চাশ হাজার ডলার মূলধন তৈরী করা ভীষণ কঠিন। তারপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়না। টাকাই এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে সেটাই হয়েছিল পচাত্তর-উত্তর নব্য ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। তারা এখনো অর্থ সা¤্রাজ্যের মালিক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আরও কিছু নব্য-ধনী একই প্রক্রিয়ার তৈরী করেছে। বলা ভালো, বড় ধনীর রাজনৈতিক অঙ্গিকার থাকে না। তারা ধনী হবার বাসনায় রাজনীতি করেন। অতিধনী হবার পর সব ধনীর এক রা। জামাতি ধনী, বিএনপির ধনী, জাতীয় পার্টির ধনী এবং আওয়ামী ধনী সবাই নিজ ও গোষ্ঠি স্বার্থে এক। সবদলের ধনীরা মিলেই ধনীক শ্রেণী। তারা তাদের অবস্থান বজায় রাখতে হয়ে যায় দলহীন ধনিক গোষ্ঠি। তারা এক হয়ে অর্থশক্তিতে বলিয়ান হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করে। সরকার যতই জনবিচ্ছিন হয়, ততই তাদের ধনিক শ্রেনী নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। নাগরিকদের আয়-সম্পদ বৈষম্য বাড়তে থকে। সম্পদ পুঞ্জিভূত হতে থাকে অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে।
বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিকে নজর দেয়া যাক। গতবছর ধনী ব্যাক্তিদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে সারা বিশে^ বাংলাদেশ প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। ধনীদের সংখ্যাবৃদ্ধির শতকরা হার ছিল ১৭%। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের চেয়ে অনেক বেশী। সম্পদ ভীষনভাবে পুঞ্জিভূত না হলে, এটা হত না। সবাই জানি, বাংলাদেশে জাতীয় আয় বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮% এর বেশী, যা রিতিমত ঈর্ষণীয়। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াÑএসবদেশ প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ধারে কাছে নেই। তাহলে এই বৃদ্ধির টাকা কোথায় গেল? সরকারের প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষন করে গবেষণাপত্রে বের হয়ে এসেছে যে, প্রবৃদ্ধির অর্থ পুঞ্জিভূত হয়েছে দেশের সর্বোচ্য ৫% মানুষের হাতে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ প্রবৃদ্ধির তেমন একটা ভাগ পায় না। জনপ্রতি গড় আয় বাংলাদেশে বেশীই হবে, কারন জাতীয় আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলেই মাথাপিছু আয় বেরিয়ে আসে। যেহেতু জনপ্রতি গড় আয় কোন ব্যক্তিরই প্রকৃত আয় নয়, গড় আয় মাত্র, সেহেতু এই সংখ্যা প্রকৃত আয়ের তথ্য গোপন করে। ধরা যাক একজনের গড় আয় দশ কোটি টাকা, অন্য একজনের দশ হাজার টাকা। তাহলে জনপ্রতি গড়-আয় দাঁড়ায় ৫ কোটি ৫ হাজার টাকায়। দশ হাজার টাকা আয়ের ব্যাক্তিটির আয়ের প্রকাশ কি এই গড় আয়ে ঘটে? মাথাপিছু গড় আয়ে বাংলাদেশের একই ঘটনা ঘটেছে।
মানুষে মানুষে আয়ের বৈষম্য হিসাব করতে অর্থনীতি শাস্ত্রে জিনি সহগ ব্যবহৃত হয়। জিনি সহগ দশমিক তিন (.৩) এর কাছাকাছি থাকলে আয় বৈষম্যকে সহনীয় বলা হয়। .৪ (দশমিক চার) এর আশেপাশে থাকলে আয় বৈষম্যের বৃদ্ধি সংকেত ধরা যায়। .৫ হলে চরম আয় বৈষম্য প্রকাশ পায়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর জিনি কোয়োফিশিয়েন্ট ছিল .৩৪। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে ছিল .৪০। জিনি সহগ বৃদ্ধি পেয়ে .৪৪ হলো ২০১০ সালে। বর্তমানে জিনি সহগ প্রায় .৫ এর গা ঘেষে। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সর্বাধিক এবং ভয়ংকর আয় বৈষম্যের দেশ। এখানে ধনী বীরদর্পে আরও ধনী হচ্ছে। আর গরীর মধ্যবিত্তেরা অনুপাতিক হারে আয় বাড়াতে পারছে না। ফলে, ধন সম্পদের সাথে সাথে ক্ষমতা ও জনগণের কাছ থেকে ধনীচক্রের কাছে হস্তান্তরিত হচ্ছে। পরিবেশিত তথ্য-পরিসংখ্যান থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে সাথে তাঁর অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নির্দয়ভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু-কন্যার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। কিন্তু তাঁর অর্থনৈতিক নীতিমালার পূর্নজাগরণ হয়নি। বরং আয়-সম্পদ বৈষম্য ভীষনভাবে বৃদ্ধি পেয়ে অল্প সংখ্যক পুঁজিপতি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন। তাদের উল্লস্ফন ও কনুইয়ের আঘাতে মধ্যবিত্ত-স্বল্পবিত্ত শ্রেণী পর্য্যুদস্থ। সরকারে থাকা নেতৃবৃন্দ আয়-সম্পদের বৈষম্যের কথা মুখেই আনেন না। তাঁরা বলেন, “দারিদ্র বিমোচন ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের’ কথা। সমাজিক নিরাপত্তা ব্যয় বাড়িয়ে ক্ষুধা মুক্তি অনেকটা সম্ভব হলেও দারিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়। সম্ভব হলে, বিশে^র সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র বিমোচন হয়ে যেত। কিন্তু হয়নি। কোনদিন হবেও না, তাদের দরিদ্র মানুষ শতকরা সতের ভাগ। এজন্যেই দুরদর্শী বঙ্গবন্ধু বৈষম্য নিরসনের কথা বলেছিলেন। দারিদ্র বিমোচনের মধ্যে থেমে থাকেননি। আমরা বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক নীতিমালা থেকে বিচ্যুত হয়েছি। বঙ্গবন্ধু তাঁর নীতিকে শুধু ভাষণে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। তিনি বৈষম্য বিরোধী নীতিমালা সংবিধানে সন্নিবেশ করেছেন, যা নিবন্ধের প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা যে সংবিধানকে অবহেলা করেছি এবং এখনো করে যাচ্ছি, একথা তো বলাই যায়। প্রশ্নও রাখা যায়, আমরা কি সংবিধানের অর্থনৈতিক নীতিমালা লঙ্ঘন করছি?
0 Comments