-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
রাজনৈতিক নেতারা তো বটেই, আমরাও বলে যাচ্ছি, আমাদের জিডিপি বা জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি শতকরা আটভাগের বেশী, যা এতদঞ্চলে সর্বাধিক এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে ঈর্ষনীয়! কিন্তু প্রবৃদ্ধিটা কাদের? নাগরিক-জনসাধারণের নাকি শতকরা দু’চার ভাগ অসাধারন ধনীদের। তাদের মধ্যে কতজন স্বাভাবিক উদ্যোক্তা, আর কতজন লুণ্ঠনকারী, সে পরিসংখ্যান আমাদের জানা নাই। গবেষনা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে জনগণের ধারনা সুস্পষ্ট। আজ সে কথা থাক।
বছরের ৩৬৫ দিনেই জাতীয় গণমাধ্যমে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়, যা সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। বছরের মাত্র একটি দিনে ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি তারিখের জাতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে মাত্র একটিতে (সমকাল) প্রকাশিত তিনটি সংবাদের প্রতি নাগরিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
পত্রিকাটির দশম পৃষ্ঠায় খবর হলো, “বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল ছেলে”। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় বদিউজ্জামান মিঠু তার বৃদ্ধ-বদ্ধা বাবা-মাকে বাড়ী বের করে দিয়েছে। হাড় কাপানো তীব্র শীতের মধ্যে মা-বাবার ঠাঁই হয়েছে বাড়ির সামনে খোলা আকাশের নিচে। সম্পত্তি লিখে না দেওয়ার কারনে একমাত্র ছেলে তাদের বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন বাবা শেখ আব্দুল মমিন (৭৫) এবং মা রিজিয়া বেগম (৬৫)। খবরটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, অর্থের অভাবে নয় বরং সম্পত্তির লোভে ছেলের এই কা-। স্বল্পকাল আগে এ ধরনের আরেকটি খবর পড়েছিলাম একসংগে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে। এক বুড়িমাকে গোয়ালঘরে শুতে দিয়ে ছেলে পৈত্রিক ঘরেই থাকে। রাতে শেয়াল এসে গোয়ালঘরের মাটিতে শুয়ে থাকা বৃদ্ধার প-কামড়ে ধরে টানাটানি করতে থাকে। বৃদ্ধার চিৎকারে ছেলে না এলেও পাড়া-পড়শীরা এসে বৃদ্ধাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বৃদ্ধার তিন ছেলে-সবাই কাজকর্ম করে, উপার্জন করে, কিন্তু মা-কে কাছে রাখতে নারাজ। ঘটনা দুটো থেকে কি প্রকাশ পাচ্ছে। পঞ্চাশ বছর আগের বাংলাদেশে এমনটা কল্পনার বাইরে ছিল। যে মা সন্তানকে আদর যতœ বড় করেছে, যে মা-য়ের পায়ের নিচে বেহেশত, সেই মাকে ঘর থেকে বাইরে বা গোয়ালঘরে রেখে আসবে, আমি এ সমাজে এমনটা আগে দেখি নাই তখন। তখন মানুষ অনেক দরিদ্র ছিল এবং মাতৃছায়াতেই অবস্থান করতো। জাতীয় আয় বেড়েছে। মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে। তবু কেন মা-বাবাকে অবজ্ঞা? মাতৃভক্তি বাদ দিলাম মায়ের প্রতি সামান্য কর্তব্যবোধ কোথায় গেলো? সাম্প্রতিক সময়ে মা-বাবার দেখা শুনার জন্য আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু আইন না থাকার সময়ে যা হয়নি, এখন তো আইন অমান্য করেই তেমনটা হচ্ছে। কারন খুজঁতে অনেক গভীরে যেতে হবে।
‘সমকাল’ পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় (পৃ-১৬) খবর বেরিয়েছে “নোয়াখালীতে মা-য়ের পিটুনিতে মেয়ের মৃত্যু।” নোয়াখালীর চাটখিলে অষ্টম শ্রেনীর স্কুলছাত্রী মারিয়া আখতারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তার মা মনি আক্তার। মা সকালে মেয়েকে নাশতার জন্য রুটি তৈরী করতে বলে। মেয়েটি তা করেনি। ক্ষিপ্ত হয়ে মা তাকে লাঠিপেটা শুরু করলে মাথায় আঘাত লেগে মেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে এবং সহসাই তার মৃত্যু ঘটে। স্বল্পকাল আগে পত্রিকার খবরে জেনেছিলাম, একজন মা তার দুই শিশু-সন্তানকে গলাটিপে মেরে ফেলেছিল। পরে জবানবন্দী দিতে গিয়ে মায়ের বক্তব্য ছিল, সে কেন নিজ সন্তাদের মেরে ফেল্ল, তা সে জানে না। পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, মা সন্তাবত: ঈষৎ অপ্রকৃতিস্থ। বড় সন্তানটির বয়স ছিল ৭ বা ৮, ছোটটি ৩/৪ বছর। এত বছরে ¯েœহ-মমতার যেমন অভাব হয়নি, তেমনি এত বছর পর এই নির্মমতার কারন কি ? পরিবারটি দারিদ্র ছিল না। মনোমালিন্য ও নাকি ছিলনা পরিবারে। তহলে কারন কি ? কারন খুঁজতে অনেক গভীরে যেতে হবে।
তৃতীয় খবরটি বেরিয়েছে পত্রিকার ৭ম পৃষ্ঠায়, “বগুড়ায় চুল কাঁটার সিরিয়াল নিয়ে যুবক খুন।” বগুড়া সদরের নুনগোলা এলাকায় দুবৃত্তরা আবু সাঈদ নামক একজন ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। নুনগোলা বাজারের একাটি সেলুনে আগে পিছে চুলকাটার সিরিয়ালকে কেন্দ্র করে দু’ যুবকের বাকবিতন্ডা হয়। সেখানে উপস্থিত আবু সাঈদ উভয়কেই বাগবিতন্ডা না করে বরং অন্যত্র যেতে বলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ঝগড়ালিপ্ত দু জনের একজন বেরিয়ে যায় এবং কিছুক্ষন পর দলবল সহ এসে আবু সাঈদকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। তার চিৎকারে স্থানীয়রা ছুটে এলে আঘাতকারীরা পলিয়ে যায়। শুরুতর আহত আবু সাঈদ পরে মারা যান। ঝগড়াঝাটি তো হতেই পারে। হয়ে ও থাকে। কিন্ত এই ঘটনাটির কারন এবং পরিনতি কি ভাবে ব্যখ্যা করা যায় ? সেলুনে যে আগে আসে, সেই তো আগে চুল কাটবে। পরে এসে আগে চুল কাটাতে চাইলে মনোমালিন্য হতে পরে, বিবাদ থেকে ঝগড়া ও হতে পরে। উপস্থিত অন্যকেউ ঝগড়া না করার অনুরোধ করতেই পারে। অত:পর বাইরে থেকে গুন্ডা এনে ঝগড়াকারীকে নয়, বরং তৃতীয় ব্যক্তিকে ছুকিরাঘাত করার ঘটনাটি কি ভাবে ব্যখ্যা করা যায় ?
ঘটনা তিনটি একসাথে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হলো পাঠকদের চিন্তাশক্তি জাগ্রত করা। কেন এমনটা ঘটছে। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় না। কারন ঘটনা তিনটি একটি মাত্র জাতীয় দৈনিকে একদিনেই বেরিয়েছে। ঘটনা গুলো ঘটছে। অহরহ ঘটছে। যুক্তিহীন ভাবে ঘটছে। আস্বাভাবিক ভাবে ঘটেই যাচ্ছে। যদি একমাস যাবৎ জাতীয় দৈনিকসমুহে প্রকাশিত এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা গুলো একত্রিত করা যায়, তাহলে সামজিক অস্থিরতার ব্যপকতা এবং গভীরতা ফুটে উঠবে।
ঘটনা গুলো যে দারিদ্রের জন্য নয় এবং অর্থাভাবে হয়নি, সেতো পরিষ্কার। ব্যক্তিগত বিরোধের কারনে ও ঘটেনি। অসুস্থতার জন্য ও ঘটেনি। কেউ বলেবেন সমাজে পচন ধরেছে। কেউ বলবেন সমাজ পাল্টে গেছে। কেউ বলবেন, দেশীয় নৈতিকতা-নীতিবোধ শিথিল হয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন ? অস্বাভাবিক পরিবেশে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করে। দোষটা আচরণের নয়, বরং পরিবেশ পরিস্থিতির। আগে আমরা যখন সবাই কমবেশী দরিদ্র ছিলাম, তখন বৈষম্য ছিল কম। তাই দারিদ্র আমাদের স্নেহ-ভালোবাসা, সহানুভূতি, মানবতা কেড়ে নিতে পারেনি। কিন্ত যখন জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৮% হল মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়াল প্রায় দু’হাজার ডলারে অর্থাৎ দেড় লক্ষ টাকার উপর তখন সমতা ভেঙ্গে গেল। ধরা যাক, দু’জন পথশিশু একসাথে রাস্তায় থাকে। একসাথে খায়। একসাথে উপোস করে। ওদের একজন লুটপাট করে ‘মুলধন’ জোগাড় করলো। তারপর ব্যাংক লুট করে এবং কন্ট্রাক্টারিতে কাজ না করেই ঘুষ দিয়ে বিল নিয়ে বিরাট বড়লোক হয়ে গেল। ওদের বন্ধুত্ব কি আর থাকবে ? দু‘জনের ‘মূল্যবোধ’ কি একরকম হবে। যে ধনী হয়েছে, সে আরো ধনী কি করে হবে, কার মাথা ফাটাবে, কার সম্পদ লুট করবে, এ চিন্তাই তার থাকবে। অন্য জনের মধ্যে ‘অবিচার’ দেখে হিংসা-বিদ্বেষ জেগে উঠবে, হিংসা ও হয়ে উঠতে পরে। এটি একটি উপমা মাত্র। জাতিয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে স্ফীত হয়েছেন শতকরা দু চার জন। বাকী ছিয়ানব্বই বা আটানব্বই জনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সামান্যই। একটি বড় অংশের ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতির সমান বা একটু উপরে। অনেকে মুদ্রস্ফীতি সামাল দিতে পারেনি। জন প্রতি গড় আয় কারো প্রতিই প্রযোজ্য নয়। এটি একটি ধাঁধাঁ মাত্র। এটাকেই বলা হয় অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানুষ অস্বাভাবিক আচরন করছে। বলা যেতে পারে, মানুষের হাতের পাঁচটা আঙ্গুল ও তো সমান নয়। ঠিক কথা। একথাও তো ঠিক যে, একটি আঙ্গুল পচিশ ইঞ্চি লম্বা এবং চারটি আঙ্গুল তিনচার ইঞ্চি-এমন অস্বাভাবিক ঘটনা প্রকৃতিতে নাই। মানুষ যখন প্রকৃতি বিরোধী আচরণ করে, তখন সমাজ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখন সেটাই ঘটছে। বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতির সমতাভিত্তিক সুষম আয়-সম্পদ বন্টন ব্যবস্থা প্রবর্তিত না হলে, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে অশান্তির বাংলাদেশে।
0 Comments