ব্যতিক্রমি মানুষ ও ব্যাংকার: আল্লাহ মালেক কাজেমী
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাস। আমি নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (ইওইগ) এর ফ্যাকাল্টি সদস্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালিন ডেপুটি গভর্নর এ,কে, গঙ্গোপাধ্যয় আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বাধীনতার পর প্রথম ব্যাচ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর নিয়োগের সিন্ধান্ত হয়েছে। আপনি রিক্রুটমেন্ট ও ট্রেনিং বিষয়ে ভারতের এন, আই. বি, এম থেকে দীর্ঘ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। নতুন ধাঁচে প্রশ্নপত্র প্রনয়ণ করা এবং প্রার্থী যাচাই করার দায়িত্ব আপনাকে দিচ্ছি। রিক্রুটমেন্ট কমিটিতে ছিলেন আইবি এ-র পরিচালক অধ্যাপক শফিউল্লাহ এবং আমি। পরামর্শক ছিলেন আই. এম. এফ নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ ড. এস. এস কুলকার্নি। ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আল্লাহ মালেক কাজেমী। নিয়োগপ্রাপ্ত ৮০ জনের প্রথম প্রশিক্ষণ কর্মকান্ডের কো-আর্ডনেটর বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রবীণ কর্মকর্তা এবং যুগ্মভাবে আমি। প্রশিক্ষণ শেষে মূল্যায়নে ও প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আল্লাহ মালেক কাজেমী। কাজেমী পড়াশোনা করেছিলেন পদার্থ বিদ্যায়। প্রশ্নপত্র যেহেতু গতানুগতিক বিষয় ভিত্তিক ছিল না, বরং বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ছিল, সেহেতু উচ্চতর আই-কিউ সম্পন্ন কাজেমী প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
১৯৯৮ সালে আমি সোনালী ব্যাংকের ম্যানোজিং ডিরেক্টর ছিলাম। হঠাৎ করেই আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গর্ভনর করে পাঠানো হল। লুৎফর রহমান সরকার তখন গর্ভরন। পরম আনন্দে দেখতে পেলাম গত বাইশ বছরে প্রথম ব্যাচটি তরতর করে উঠে এসেছে। আল্লাহ মালেক কাজেমীই ব্যাচের জ্যেষ্ঠতম নির্বাহী রয়ে গেছেন। জ্ঞান এবং কর্মে পারদর্শিতার জন্য সহকর্মীরা তাকে সম¥ান করে। বিশেষ করে বৈদেশিক বানিজ্য বিষয়ে তার পারদর্শিতা সর্বজন স্বীকৃত। জটিল বিষয়ে তার সহকর্মীরাও তার সাথে পরামর্শ করতো। কাজেমী ছিলেন নিরবকর্মী, নিভৃতচারী। জোর করেও তাকে সামনে আনা যেত না। অনেক অনুরোধ করতাম ইওইগ এ নিয়মিত ক্লাস নেয়ার জন্য। না, ওটি তার দ্বারা হতো না। অথচ ডেস্কে বসে কাজ করা এবং জটিল বিষয়ের সমাধান বের করার ক্ষেত্রে তার জুড়ি ছিল না।
বছর দু’য়েক পরের কথা। কাজেমী অফিসে আসছেন না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিনি অসুস্থ। হার্টের সমস্যা। তার স্ত্রী অভিযোগ করলেন যে তিনি হাসপাতালে যেতে চান না। তাঁর সাথে কথা বলে জানা গেলো, হাসপাতালের খরচার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। যাই হোক, তাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করা হল। একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ডাক্তার বলেছেন, অপোরেশন লাগবে। অপোরেশন মেটাবার খরচ তাঁর নেই। তাঁর সাফ কথা, ধারকার্জ করে তিনি চিকিৎসা করাবেন না। কারন বেতন থেকে ধার শোধ দেওয়া সম্ভব না। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বিধিতে চিকিৎসা খরচ প্রদানের ব্যবস্থা নেই। ঐ সময়ের গভর্নর ছিলেন ড. ফরাসউদ্দিন। তিনি অর্থ সচিব ড. আকবর আলী খানের সাথে সাক্ষাত করে একটা ব্যবস্থা করার অনুরোধ করলেন। ড. আকবর আলী খান শেষ পর্যন্ত ‘বিশেষ বিবেচনায়’ দুই লক্ষ টাকা চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের অনুমোদন দিলেন। তারপর কাজেমী ভারতের দিল্লীতে গিয়ে হার্ট অপারেশন করে দেশে ফিরলেন। কাজেমী নিজের জীবনের চেয়েও সততাকে উর্ধে স্থান দিতেন। তিনি সততা নিয়ে নিছক কথা বলতেন না। সততা পালন করতেন। তা যে কোন মূল্যে। বর্তমান কালে সততার এমন নিদর্শন আমি আর দেখাতে পাই না।
২০০১ সালে আমি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহন করলাম। সম্ভবত: ঐ বছরই কাজেমী ডেপুটি গভর্নর পদে পদোন্নতি পেলেন। দীর্ঘদিন ঐ পদে কাজ করার পর তিনিও অবসর গ্রহন করলেন। গভর্নর তাকে ‘পরামর্শক’ পদে নিয়োগ দিতে চাইলেন। তাকে বলা হলো, একটি আবেদনপত্র লেখার জন্য। সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি আবেদন করবেন না। তাকে পরামর্শক পদে নিয়োগ দিলে, তিনি যোগদান করবেন, কিন্তু আবেদন করবেন না। মহা মুছিবত। সম্ভবত গভর্নর সাহেব আমাকে বিষয়টি জানালেন। আমি কাজেমীর বাসায় গেলাম। কাজেমী বাসায় ছিল না। তার স্ত্রী যা বললেন তার সারমর্ম হলো, তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন নয়। পরামর্শকের কাজটি করলে ভালো হয়। কাজেমী কেন এমন করছেন, তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি আমাকে বললেন, কাজেমীকে বুঝাতে। বলে তিনি চা বানাতে ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষনের মধ্যে কাজেমী ফিরে এলেন। আমি ¯েœহের সাথে ঈষৎ রাগত স্বরে বললাম, ‘কাজেমী কি শুরু করেছেন? চাকুরী দরকার অথচ আবেদন করবেন না। এ কেমন আচরন?’ কাজেমী ঈষৎ লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘স্যার, ব্যাপারটা এরকম না। গভর্নর সাহেব আমাকে কিছু বলেননি। ডিপার্টমেন্ট থেকে ওরা বলছে।’ ঘটনা বুঝতে পেরে আমি তাকে নির্দেশই দিলাম যেন কাল সকালে তিনি আবেদন গভর্নরের কাছে পাঠিয়ে দেন। গভর্নর সাহেব আমাকে বলেছেন। পরদিন সকালেই কাজেমী আবেদন করেছিলেন। সাথে সাথে তার নিয়োগও হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে মৃত্যু অবধি তিনি কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। সুনামের সাথে। মাথা উচু করে। তাকে আর অবসর নিতে হয়নি। তাকে আর আবেদন করতে হবে না কোনদিন।
0 Comments