Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: যে বিবেকের মৃত্যু নেই

 খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: যে বিবেকের মৃত্যু নেই

-    ড. আতিউর রহমান

আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন মানুষের মধ্যে অন্যতম একজন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। আলোকজ্জ্বল এবং ক্ষুরধার জ্ঞানসম্পন্ন এক মানুষ ছিলেন তিনি। আর্থিক খাতের সুশাসন ও সৃজনশীল ধারণায় যিনি খ্যাত হয়ে উঠেছিলেন সর্বত্র। আবার রাষ্ট্র ও সমাজের অনিয়মের বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণে যিনি নিজেকে অন্যভাবে অলঙ্কৃত করেছিলেন। বাংলাদেশ আর বাঙালির প্রশ্নে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন আপোসহীন এক কণ্ঠস্বর। ছিলেন একজন সংবেদনশীল ও সামাজিক দায়বদ্ধ বিবেকবান মানুষ। বিবেককে যিনি কখনই বন্ধক রাখেননি। এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি এই সাহসী মানুষটিকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। কোভিড দুর্যোগে গত একবছরে সমাজে ও সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখা অনেক প্রাজ্ঞ সুধীজন, বন্ধুজনকে হারিয়েছি আমরাÑযাঁরা আলোকিত সমাজ গড়তে নিবেদিত ছিলেন।  সেই শোকের মিছিলে যোগ দিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ভাইও চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। তাঁর শূন্যতা কবে পূরণ হবে জানিনা। তবে আমাদের হৃদয় জুড়ে তিনি রয়েছেন এবং থাকবেন চিরদিন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের জীবনের পথ-পরিক্রমা অনেক দীর্ঘ। যে জীবন কেবলই রঙ ছড়িয়েছে চিন্তায়-মননে-মানুষের মঙ্গলে। পেশাগত জীবনে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ব্যাংকার। পাকিস্তান আমলে তিনি ব্যাংকিং পেশায় যোগ দেন। দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসর নেওয়ার পর পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিশেবে দায়িত্ব পালন করেন।’ ৯০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত ‘আর্থিক খাত সংস্কার’ বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্যও ছিলেন তিনি। মৃত্যু পর্যন্ত অনেক ধরনের সামাজিক কর্মকা-ের নেৃতত্ব দিয়েছেন তিনি। দুর্গম চরে বসবাসরত বঞ্চিত মানুষের উন্নয়নে তিনি  ভীষণ সোচ্চার ছিলেন। চরের মানুষের জীবন-জীবিকা উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ জোট‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’ (এনসিএ)-এর সভাপতি হিশাবে তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেন। আবারশিশু-কিশোরদের জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনেতাঁর নিবেদন অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে নতুন প্রজন্মের কাছে। সবার প্রিয়রোকনুজ্জামানের (দাদাভাই) মৃত্যুর পর ‘কচি-কাঁচার মেলা’ পরিচালনার দায়িত্ব একনিষ্ঠতার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের মধ্যে মননশীলতার চর্চা ও তাদের সার্বিক বিকাশে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। শেষ জীবনে সেগুন বাগিচাস্থ কচি-কাঁচার মেলা অফিসটিতেই তিনি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। এটি তাঁর খুব প্রিয় জায়গা ছিল। কতবার কত ডাকেএই মেলার অফিসে গিয়েছি এবং শিশুদের সৃজনশীল কাজ দেখেছি। শিশুবান্ধব খালেদ ভাই বরাবরই শিশুদের চোখ দিয়ে আমাদের এই পৃথিবীটাকে দেখতে বলতেন।


মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন থেকেই ভয়ে ছিলাম। প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন শ্যামলীর স্পেশালাইজড হাসপাতালে। পরে তাঁকে ভর্তি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোভিড থেকে তিনি মুক্তও হলেন। কিন্তু নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতা কাটছিলো না। হাসপাতাল থেকে তাঁর ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে দেখভাল করার জন্য একজন প্রশিক্ষিত নার্সও ঠিক করা হয়েছিলো। সে সময় খানিকটা আশার আলো দেখছিলাম যে, না খালেদভাই ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। কিন্তু আমাদের হতাশ করে চলে গেলেন প্রাণপ্রিয় খালেদভাই।


আমার পেশা-জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনেও যাঁর ব্যাপক অবদান এমন একজন মানুষকে হারানোর বেদনা বলে বা লিখে বোঝানো ভার। তাঁর সঙ্গে আমার কতো সুখ স্মৃতি। এমন সহমর্মী  খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ নয়। তাই তাঁর পরিবারের সদস্য কিংবা ভক্ত-অনুরাগীদের সান্ত¡না জানানোর ভাষা আমি খুঁজে পাইনি।পাওয়ার কথাও নয়। এমনিতেই বর্তমানে পুরো সমাজ একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এ সময় এমন একজন মানবিক এবং দেশপ্রেমিক চিন্তক ও কর্মী মানুষকে হারানো আসলেই মন ভেঙ্গে দেয়। আমার মতো যারা তাঁকে কাছে থেকে চিনতেন তাঁদের জন্য এ ব্যাথা আরও তীব্র। দেশের মানুষ তাঁকে দুর্নীতি-বিরোধী আপোসহীন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিশেবে স্মরণ করবে।
আমার কাছে তিনি ছিলেন ছায়াদানকারী বড়ভাইয়ের মতো। ছিলেন আমাদের সুসময়ে এবং দুঃসময়ে একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু। আর সর্বদাই ছিলেন ভরসার আশ্রয়স্থল। আর্থিক খাতে কাজ করলেও এ খাতের পাশাপাশি সমাজের সর্বত্রই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক লড়াই করে গেছেন আজীবন। সমাজের বহুবিধ বৈষম্য, অন্যায়-অনিয়ম, নীতিহীনতা, মূল্যেবোধের অবক্ষয় তাঁকে উদ্বিগ্ন করতো। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পথ হারিয়ে ফেলা তিনি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারতেন না। এ কারণেই তিনি তাঁর জায়গা থেকে নির্মোহভাবে বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণ করে বক্তব্য দিতেন। তাঁর অনেক বক্তব্যেই খুঁজে পাওয়া যেতো বাংলাদেশের শেকড়ের সন্ধান। তিনি বিশ্বাস করতেনÑযে আদর্শের ভাবধারায় বাংলাদেশের জন্ম সেই সত্য জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসা যাবে না। আর তাই তো কখনই নিশ্চুপ থাকেননি, উচ্চকিত হয়েছেন। সাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলেছেন। কখনই তিনি কাউকে খুশি বা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কথা বলেননি। বরাবরই যা বলেছেন তা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য, গণমানুষের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি রুঢ় সত্য উচ্চারণ করেছেন পেছনে না তাকিয়ে। এ কারণেই সাহসী চরিত্র হিশেবে তিনি সবার মন জয় করেছিলেন। সমালোচকই যে সত্যিকারের বন্ধু তা এই সমাজের মনোজগতে এখনও ঠাঁই করে নিতে পারেনি। তাই তাঁকে ভুল বোঝার মানুষের অভাবও ছিল না।
খালেদভাইয়ের সঙ্গে যারাই কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে সবাই এ কথা স্বীকার করবেন যে, নিজের নৈতিক শক্তি তিনি অন্যদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে সদা-সচেষ্ট থেকেছেন। আমাদেরই দুর্ভাগ্য যে আরও বেশিদিন তিনি এ দেশের আর্থিক খাতে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাননি।আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিশাবে দায়িত্ব পালনকালে বহুবার আমরা দু’জন একইসঙ্গে গ্রামাঞ্চলে গিয়েছি সহজলভ্য কৃষিঋণ বিতরণের কর্মসূচি নিয়ে। সে সময় এ দেশের কৃষি খাত ও প্রান্তিক কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে তাঁর একাগ্রতা নতুন করে অনুভব করেছি।আমার অনুপস্থিতিতে আমার প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমন্বয়ের গণবান্ধব গবেষণা কার্যক্রমকেও এগিয়ে নিয়েছেন মানুষের প্রতি দরদের জায়গা থেকেই। আমার অবর্তমানে চরের মানুষের জন্য নিবেদিত ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর হাল ধরেন তিনি। চরের মানুষের উন্নয়ন, অধিকার, জীবন-জীবিকা, নীতি-প্রস্তাবনা বিষয়ক সব ধরনের আলোচনাতে  তিনি নিজ দায়িত্ব নিয়ে যেতেন। নিজের গাড়ির তেল ফুরিয়ে অংশ নিতেন বিভিন্ন সভাতে। চর অ্যালায়েন্সের কাজে কোনোদিন একটাকা আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করেননি তিনি। চরের মানুষের উন্নয়নে তাঁর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অনন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকবে এই জোটের সদস্যদের কাছে। মনে আছে, ২০১৫ সালের ৬ জুন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে একহাজারেরও বেশি মানুষের অংশগ্রহণে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় চর সম্মেলনে তিনি সভাপতি হিশেবে দায়িত্ব পালন করেন।   
সাধারণ মানুষের বিশেষ জ্ঞানকে (উইসডম) তিনি সবসময় সমীহ করতেন। তাদের সৃজনশীলতাকে তিনি সম্মান জানাতেন। আর তাই বক্তব্যে প্রায়শই বলতেন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না জানলেও প্রতিটি অধিকার বঞ্চিত মানুষের মধ্যে এক ধরনেরবিশেষ জ্ঞান লক্ষণীয়। সেই জ্ঞানের মূল্য অনেক। সেই জ্ঞানকে আমাদের শ্রদ্ধা করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে। চরের মানুষের পক্ষে কথা বলতে, চরের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে তিনি অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রীসহ কতো না মন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন। বিনয়ের সাথে বলেছেনÑ চরের মানুষের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ান। চরের মানুষের দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিন। চরের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কলেবর বৃদ্ধি করুন। সর্বোপরি, চরের মানুষের পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চর ফাউন্ডেশন বা চর বোর্ডÑএরকম একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলুন। মৃত্যু অবধি তিনি এই কথাগুলো বারবার বলে গেছেন নীতি-নির্ধারকদের কাছে।     
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ লিখতে এবং পড়তে ভীষণ পছন্দ করতেন। জীবদ্দশায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন তিন। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ও মহানায়ক’, ‘ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে’, ‘কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’, ‘ব্যাংকিং সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা’, ‘জীবন যেখানে যেমন’। এ-সব বইও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে ঢের। প্রতিটি বইয়ে আমরা দেখেছি তাঁর বিশ্বাস, দেশপ্রেম এবং জীবনবোধের ¯িœগ্ধ উচ্চারণ। বেশিরভাগ কথাই তিনি বলেছেন ছোট ছোট করে; কিন্তু প্রতিটি কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে গভীর চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং জীবনবোধ। যে কথা আগেই বলেছি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ নিজের জন্য কখনই কোনো কথা বলেননি। বলেছেন দেশ ও সাধারণ জনগণের জন্য। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন অন্যায়-অনিয়ম-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে এক অতন্দ্র প্রহরী। নির্লোভ ভ্যানগার্ড।
দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। প্রচলিত শিক্ষায় অনেক ভুলত্রুটি তিনি তুলে ধরতেন। তিনি মনে করতেন প্রগতিশীল বিজ্ঞানভিত্তিক একটি শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারাটা আমাদের বড় এক ব্যর্থতা। একইসাথে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করতে না পারাটাও অনেক বড় ব্যর্থতা। তিনি বারবার মনে করে দিয়েছেন এই কথা যে, জাতিগঠনে শিক্ষালয় তথা শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আমাদের কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি পশ্চাৎপদ সমাজকে ভোগ করা দুর্বল নেতৃত্বের লক্ষণ। আমরা চাই বঙ্গবন্ধুর মতো সবল নেতৃত্ব; যে নেতৃত্ব সমাজের প্রয়োজনে আঘাত দিয়ে জাগিয়ে তোলে। (কিছু স্মৃতি, কিছু কথা, পৃ. ৫৩)।
বাংলা ভাষার প্রতি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মমত্ব ছিল অসীম। তিনি বলতেন, ভাষা হলো আপন সত্তা। আর বাঙালির ভাষার সংগ্রাম এক অতুলনীয় মহাকাব্য। পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পর ভাষার উপর যে আঘাত আসে তিনি তাঁর প্রতিবাদ করেন বিভিন্ন বক্তব্যে ও লেখায়। তিনি লিখেছেন, “পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পর চিন্তা চেতনায়ও যেনো পরিবর্তন এল। ঘোষণা এল, শাসনতন্ত্রিক ব্যাখ্যার জন্য শাসনতন্ত্রের ইংরেজি অনুবাদ মূল বলে বিবেচিত হবে। কিছু কিছু বাংলা নাম পাল্টে গেল। বাংলাদেশ বেতার হলো- রেডিও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বিমান হলো- বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, চালনা বন্দর হলো- পোর্ট অফ চালনা। বাংলা যেনো আসামীর কাঠগড়ায়। একুশেও যেন আসামীর কাঠগড়ায়। একুশের দোষ একুশ সংগ্রাম করতে শিখিয়েছিল, একুশ বাঙালির অহংবোধকে জাগিয়েছিল- সংহত করেছিল”। (কিছু স্মৃতি কিছু কথা, পৃ. ৬৩)।
রাষ্ট্রে-সমাজে সুনীতির সঙ্কটকে বরাবরই পর্যবেক্ষণ করেছেন এই মুক্তচিন্তার স্পষ্টবাদী মানুষটি। তিনি প্রায়শই বলতেন, দুর্নীতি যখন সুনীতিকে অতিক্রম করে যায়, তখন সমস্যাটা সঙ্কটে রূপ নেয়। আর সঙ্কটটের পর সুনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা একটি কঠিন প্রক্রিয়া। আত্মপরিচয় নিয়েও তাঁর পর্যবেক্ষণ-অনুসন্ধান মনে রাখার মতো। বলতেন পাশ্চাত্যের আকর্ষণ আর মধ্যেপ্রাচ্যের টানে আমরা আমাদের অনেক কিছুই নির্বাসনে দিচ্ছি। আত্মপরিচয় ভুলে গেলে বিভ্রান্তি বাড়ে। তাঁর উচ্চারণ-“বায়ান্নতে আত্মপরিচয় পেয়েছিল বলেই বাঙালি স্বাধীনতা পর্যন্ত অর্জন করেছিল। কিন্তু এরপর শুরু হলো আত্মবিস্মৃতির পালা। মাতৃভাষার প্রতি চরম অবহেলা, মাতৃভূমির প্রতি বিদ্বেষ, আপন কৃষ্টিকে অস্বীকার। এই তিন অপরাধ থেকে মুক্ত হতে না পারলে সঙ্কট ঘনীভূত হতে থাকবে।” (ব্যাংকিং সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা, পৃ. ১১৬)
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে তাঁর বোঝাপড়া ছিলো ইতিহাসের নিরেট সত্যতার কষ্টিপাথরের আলোকে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাঙালির মানসসত্তা গঠনের ভিত্তিÑ এটি তিনি সবসময় বলতেন। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর উচ্চারণ-“নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ কোনো নতুন, বিচ্ছিন্ন বা খ-িত ঘটনা নয়, বরং সুদীর্ঘ আন্দোলনের সশস্ত্র অধ্যায়। এই যুদ্ধ কোনো কনভেনশনাল যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল সর্বাত্বক জনযুদ্ধ-ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, সেনাসদস্য, সরকারি আমলাসহ সমাজের সর্বস্তরের সকল অংশ এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এজন্যই হানাদার বাহিনী মানুষ হত্যা করেছে-জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি।” ( কিছু স্মৃতি কিছু কথা, পৃষ্ঠা ৩১)  
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করতেন।  বঙ্গবন্ধুপ্রেমী এই মানুষটি বেড়ে ওঠার সময় খুব কাছে থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুকে। স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশপ্রেম ও গণমুখিতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। তাই ন্যায়ের প্রশ্নে, মানুষের কল্যাণের প্রশ্নে আপোসহীন থাকতে চেষ্টা করেছেন সেই অনুপ্রেরণার জায়গা থেকে। নব্বই দশকে যখন বঙ্গবন্ধুর নামটি নিতেও অনেকে ভয় পেতেন সে সময় পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিশেবে মাথা উঁচু করে খালেদভাই দায়িত্ব পালন করেছেন মাথার ওপর বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গিয়ে। নীতির প্রশ্নে কখনও আপোস করেননি বলেই সবসময় এমন নিঃশঙ্ক চিত্তে কাজ করতে পেরেছেন।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক ভাবনা বিষয়ক গবেষণার প্রয়োজনে তাঁর একটি আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বরাবরের মতোই আমার কাজে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে অমূল্য সহায়তাও করেছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে ছেলেবেলায় বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেছিলেন- “রাজনৈতিক কারণে অনশনের বিষয়টি প্রথম বঙ্গবন্ধুকেই করতে দেখেছি আমার ছেলেবেলায়। কলকাতা থেকে সদ্যই ফিরেছেন। হঠাৎ জানা গেলো আমাদের শেখ মুজিব ভাই না খেয়ে আছেন। ছোট ছিলাম তাই বুঝিনি। ভেবেছিলাম হয়তো বাড়িতে রান্না না হওয়ায় খাচ্ছেন না। পরে বড়দের কাছ থেকে শুনলাম খুলনাতে উনি কিছু একটা দাবি করেছেন এবং সে দাবি পূরণ না হওয়ায় খাওয়া বন্ধ করেছেন। বিকেলে গণমান্য ব্যক্তিরা এসে তাঁকে খাওয়ালেন। বলা হলো তিনি ‘অনশন ভঙ্গ করলেন’। তাঁর কাছে এ-সবের কারণ জানতে চাইলে বললেন ‘বড় হয়ে বুঝবি’।”


বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব গুণে মুগ্ধ হয়ে অল্প বয়সেই তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম খালেদ। কাছ থেকে তাঁকে যতোই দেখেছেন ততোই বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের বৈচিত্রময় আর সৃষ্টিশীল দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো খালেদভাইয়ের কাছে। বঙ্গবন্ধুর চিন্তার নান্দনিকতা ও সৃষ্টিশীলতার উদাহরণ দিতে গিয়ে খালেদভাই চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- “তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) নেতা অর্থাৎ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভারত থেকে ফিরছেন দেশে। বঙ্গবন্ধু বড় সভা করবেন মনস্থ করলেও স্বভাবতই বাঁধ সাধলো নুরুল আমিনের সরকার। জারি করা হলো ১৪৪ ধারা। বয়সে ছোটরা আবেগী হলেও, বঙ্গবন্ধু সকলকে শান্ত থাকতে বললেন। ‘খামোখা এরেস্ট’ না হয়ে আশেপাশে থাকতে বললেন। বিকেল ৩টা বা ৪টায় আমাদের খবর পাঠালেন আমরা যেন ৪-৫ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মধুমতির পাড়ে হাজির হই। গিয়ে দেখলাম বাঁশ দিয়ে নদীর মাঝে মঞ্চ করে সভা আয়োজন করেছেন বঙ্গবন্ধু। আর প্রশাসনকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন- ‘পুলিশ ভাইয়েরা, আপনারা বাড়াবাড়ি করবেন না। আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করেন। আমরা নিয়মভঙ্গ করবো না। কারণ আপনারা জানেন হয়তো নদীর মাঝখানে ১৪৪ ধারা থাকে না। তা হলে স্টিমার, লঞ্চ চলবে কি করে?’ প্রশাসন চেষ্টা করেও ওই সভা প- করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুর সৃজনশীলতার কারণেই।”
বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ ইব্রাহিম খালেদ সবসময়ই চাইতেন আগামী প্রজন্ম যেন বঙ্গবন্ধুর জীবন, দর্শন ও কর্মগুলো সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারে। নিজে রাজনীতি-সচেতন ছিলেন বলে ইব্রাহিম খালেদ সে সময়কার অন্য নেতাদের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার অনন্যতাটুকু ধরতে পেরেছিলেন তরুণ বয়সে। রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হননি কখনও। তবে রাজনীতির বাইরে থাকা তরুণ বাঙালিদের ধারণ করতে বঙ্গবন্ধুর যে আগ্রহ ছিলো সেটি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন ইব্রাহিম খালেদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন- “আমাদের মতো যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না তাদেরও অপশাসন-বিরোধী সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত করার কথা বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন। কবি সুফিয়া কামালের বাসায় আমরা যারা আড্ডা দিতে যেতাম তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু একটি পরামর্শ দিলেন। তিনি চাইছিলেন আমরা যেন ছোটদের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। এর লক্ষ্য হবে ভাষা আন্দোলনের পরে বাঙালির মধ্যে জেগে ওঠা আত্মচেতনা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাঁর এই পরামর্শ অনুসারেই গড়ে উঠেছিলো ‘কচি-কাঁচার মেলা’। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও পেছন থেকে সুফিয়া কামাল, আব্দুলাহ আল মুতি শরফুদ্দিন এবং রোজনুজ্জামান (দাদাভাই)Ñ এই তিনজনকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার কাজে।” সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে গিয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে নান্দনিক দেশপ্রেমের অনুশীলন গড়ে তুলতে ইব্রাহিম খালেদভাই নিজেও জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত ‘কচি-কাঁচার মেলা’ পরিচালনায় নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি কেবল ভালোবাসতেন তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাকে নিজের জীবনের অনুশীলনেও এভাবে প্রতিফলিত করেছিলেন আমাদের খালেদভাই।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্মের নান্দনিকতার উদাহরণ দিতে গিয়েও খালেদভাই ‘কচি-কাঁচার মেলা’র বিকাশে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও ভূমিকার কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের বলেছিলেন- “কচি-কাঁচার মেলার প্রতি তাঁর যে অনুরাগ তা শুরুতে যেমন ছিল পরেও তা অব্যাহত ছিল, তিনি জাতীয় রাজনীতিতে দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পরও এখানে তখনকার শিশু-সাহিত্যিকেরা আসতেন। বঙ্গবন্ধু সে সব সাহিত্যসভায় প্রায়ই এসে হাজির হতেন তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য। স্বাধীনতার পর একবার রাষ্ট্রপ্রধান হিশেবে লন্ডন সফরে সেখানকার হাই-কমিশনে এই মেলার শিশুদের আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী আয়োজন করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে সারা দেশ থেকে কচি-কাঁচার মেলার সদস্য শিশুদের নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠান হলে সেগুলোতে বঙ্গবন্ধু হাজির হতেন। স্বাধীন দেশে তিনি কর্ণধার হওয়ার পর এমন একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন আসতে না পারলেও ওই শিশুদের সান্নিধ্য পেতে তিনি আগ্রহী। নিজেই পরামর্শ দিয়েছিলেন আমরা যেন শিশুদের একটি দল নিয়ে তাঁর কার্যালয়ে যাই। আমরা গিয়েছিলামও। সবার সঙ্গে তিনি কুশল বিনিময় করেছিলেন, সবাইকে নাস্তাও খাইয়েছিলেন। মননশীল চর্চাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে কখনই তিনি কার্পণ্য করেননি।”


আগেই বলেছি ইব্রাহিম খালেদভাইয়ের লেখালেখি ও বক্তব্যের প্রধানতম বৈশিষ্ট হলো গভীর সত্য ও ন্যায্য কথাগুলো তিনি খুব সহজবোধ্য ভাষায় মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। ছোটবেলা থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখা এই মানুষটি মনে করতেন বঙ্গবন্ধুর শিল্পবোধেরও সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর কালজীয় বক্তৃতাগুলোতে; যেখানে তিনি সহজ ভাষায় মানুষের দুর্ভোগ-বঞ্চনার কথা বলে গেছেন, দিয়ে গেছেন সেই সব সঙ্কট উত্তরণের দিক-নির্দেশনাও। এ প্রসঙ্গে আমাদের তিনি বলেছিলেন- “বঙ্গবন্ধুর শিল্পবোধ সবচেয়ে প্রবলভাবে ধরা পড়ে তাঁর বক্তৃতাগুলোতে। রাজনৈতিক বক্তৃতাতেও তিনি ভেতরের প্রচ- সাহিত্য অনুরাগ প্রতিফলিত করতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রায় সব বক্তৃতাতেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ থেকে দু’-এক লাইন উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর নিজের লেখনি এতো সাবলীল আর হৃদয়গ্রাহী যে মনে হয় তিনি মানুষের সঙ্গে কথাই বলছেন। এ-জন্যই সম্ভবত তাঁকে রাজনৈতিক কবি বলা হয়।”


খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ নিজে একজন মানবিক মানুষ। পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেমন একনিষ্ঠ থেকেছেন, তেমনি পেশাজীবনের বাইরেও বৃহত্তর সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন সবসময়। এই অনুপ্রেরণাও তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- “বঙ্গবন্ধুর মানবিকতার বোধ তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর এই দিকটি খুবই স্পষ্টভাবে আমি অনুভব করেছি ১৯৬৫ সালের দাঙ্গার সময়। তখন আমি ঢাকায়। শেখ মুজিব আহ্বান জানালেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। মুসলীম লীগ বা জামাত সে সময় একটা সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছিলো। সে সময় নারিন্দায় গিয়ে দেখলাম বঙ্গবন্ধু হিন্দুদের বাড়িতে বাড়িতে যাচ্ছেন। তাদের প্রতিটি পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য লোকজনকে দায়িত্ব দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর এমন অনন্য সাহসী উদ্যোগের কারণেই অপশক্তির চক্রান্তগুলো সে সময় ব্যর্থ হয়েছিলো। 


আরও আগে আমাদের স্কুল জীবনে দেখেছি দুর্ভিক্ষের কালে আমার ছোটভাই ঘুরে ঘুরে রুটি সংগ্রহ করতেন, আর শেখ মুজিব সেগুলো নিয়ে গরীব মানুষের বাড়িতে যেতেন। যাঁরা খেতে পাচ্ছিলেন না তাঁদের কাছে খাবার পৌঁছাতে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখেছি সবসময়। তিনি বলতেন- ‘দেখ, দুটো রুটি দিলি তোদের কিন্তু কিছু হলো না, কিন্তু ওই দুটি লোক বেঁচে গেল।’ এভাবে ছোটদের মধ্যে নিজের মানবিকতার বোধটুকু সঞ্চারিত করেছেন সবসময়।’’


বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে  ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারটি দীর্ঘ। কেবল চুম্বক অংশটুকইু এখানে তুলে ধরলাম। এখান থেকে এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে কী গভীরভাবে তিনি মূল্যায়ন করেছেন। এভাবে মূল্যায়ন করেছেন বলেই খালেদভাই নিজেও সবসময় দেশের স্বার্থে কাজ করেছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। বঙ্গবন্ধুকে সবাই ভালোবাসেন। সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার সেই জায়গা থেকে নিজের ব্যক্তিজীবনের অনুশীলনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও দর্শনকে প্রতিফলিত করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ইব্রাহিম খালেদ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।


সবশেষে বলবো সমাজের ভেতরকার অনেক বিষয়ে ইব্রাহিম খালেদের ছিল সুক্ষ¥ পর্যবেক্ষণ ও গভীর অনুসন্ধান। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তিনি সেই কথাগুলো সবাইকে মনে করিয়ে দিতেন। তিনি কখনই কোনোকিছু উচ্চকণ্ঠে বলতেন না। মৃদুস্বরে নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলতেন। কিন্তু তাঁর উচ্চারণে, উপস্থাপনে বরাবরই দৃঢ়তা থাকতো। তাঁর প্রতিটি বক্তব্যে যুক্তিই প্রাধান্য পেত বেশি, আবেগের চেয়ে। সবচেয়ে বড় কথা হলো-তিনি সত্যটা উচ্চারণ করতেন নিজের মতো করে। এতে কে খুশি হলো আর কে ক্ষুব্ধ হলো, এটি ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না। তাঁর ভেতর গভীর দেশপ্রেম ছিল বলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নৈতিকতাকে একটি দেশের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম সূচক হিশেবে দেখতেন তিনি। তাই বলতেন নীতিহীন মানুষ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। সমাজের প্রতিটি স্তুরে প্রয়োজন নীতিনিষ্ঠ মানুষ। এমনকি, শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলতেন-“নীতিমান শিক্ষক অগ্রগণ্য। এটি আগে দেখে তারপর নিয়োগ দিতে হবে।” আবার এও বলতেন বাংলাদেশ আর বাংলাভাষার প্রতি যে সব স্কুল অবজ্ঞা করে তাদের সম্মন্ধে কঠোরতা প্রদর্শন করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদিতা, ধর্মীয় গোড়ামীকে কখনই তিনি প্রশ্রয় দেননি। 


আমাদেরকে দুঃখের অন্তহীন এক সাগরে ভাসিয়ে সমকালীন বাংলাদেশের বিবেক বলে পরিচিত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁকে হারাবার ব্যথা ভোলা যাবে না। তবু তাঁর চিন্তা ও কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে তাঁর আদর্শ ধারণ করতে হবে। ‘কচি-কাঁচার মেলা’কে সে জন্য আরও সচেষ্ট থাকতে হবে।
*লেখক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।






Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে