খালেদ ভাইয়ের সান্নিধ্য
শাকিল আহমেদ
কি লিখবো বুঝতে পারছি না। শুরু করেও লিখতে পারছি না। কিভাবে শুরু করলে লেখা বন্ধ হয়ে যাবে না, তাও বুঝতে পারছি না। যাঁকে নিয়ে লেখা শুরু করার জন্য ভাবছিÑ তাঁকে নিয়ে লেখার সাহসও আমার নেই, যাঁর ব্যক্তিত্ব আকাশ ছোঁয়া। তিনি ছিলেন আদর্শবান, স্পষ্টভাষী, শিশু সংগঠক, উপমহাদেশের মধ্যে সফল বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ধার্মিক, বিনয়ী ও পরোপকারী। আরও অনেকভাবে তাঁকে বিশেষনে বিশেষায়িত করা যায়। সেই মানুষটি আমাদের জন্য কি না করে গেছেন। তিনি হলেন আমার প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। যাঁকে আমি খালেদ ভাই বলে ডাকতাম।
আমি যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার শাখা হিসেবে দনিয়া সবুজ কুঁড়ি কচি-কাঁচার মেলা আমাদের স্কুলে কার্যক্রম শুরু করে। দনিয়া মেলার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমি একজন কর্মী হিসেব জড়িত ছিলাম। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার হয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে কুজকাওয়াজে অংশ নিয়েছি। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় মেলার অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছি। আমি ১৯৯২ সালে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। তারপর থেকে কুজকাওয়াজে অংশ নেওয়া হয়নি। চিকিৎসা নিতে আমাকে তিন মাস অন্তর ভারতে যেতে হতো। তাই প্রতি মাসে আমাকে ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার অথবা টিটি নিতে হতো। আমার বাবা ছিলেন ব্যাংকার। সবসময় তিনিই আমাকে ডলার অথবা টিটি ক্রয় করে দিতেন। ১৯৯৭ সালে আমি আমার গ্রামের বাড়ী স্বরূপকাঠিতে ব্যবসা শুরু করি। তখনই আমার উদ্যোগে স্বরূপকাঠি সোপান কচি-কাঁচার মেলার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে আমাকে আবারও চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে হয়। ঐ সময় আমার কাছে কিছু ডলার ছিল। ডলার ভাঙ্গানোর উদ্দেশ্যে আমার ঢাকা আসা। তাই চিন্তা করে দেখলাম ঢাকাতে যখন এসেছি দাদাভাইয়ের সাথে দেখা করবো। আমি আমার পাসপোর্ট ও ডলার সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় মেলায় এসে দাদাভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। দাদাভাই আমার কাছে জানতে চাইলেন এখন আমি কোথায় যাবো, আমি বললাম, ব্যাংকে যাবো, ডলার ভাঙ্গাতে। দাদাভাই, জানতে চাইলেন ঐ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবে এমন কেউ আমার আছে কী না? আমি বললাম, বাবা ব্যাংকে চাকরী করেন। তিনি এখন নারায়ণগঞ্জ শাখায় কর্মরত আছেন। দাদাভাই বললেন, তুমি বাংলাদেশ ব্যাংকে যাও। ঐখানে খালেদ আছে। তুমি গিয়ে বলবে আমার কথা, খালেদ সব ব্যবস্থা করে দিবে। বাবাকে বললাম আপনার আর নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে হবে না ডলার ভাঙ্গানোর জন্য। দাদাভাই আমাকে খালেদ ইব্রাহিম ভাইয়ের কাছে যেতে বলেছেন। আগামীকাল সকালে আমি যাবো বাংলাদেশ ব্যাংকে। তিনি সব ঠিক করে দিবেন। বাবা আমাকে সাথে সাথে বকা দিয়ে বললেন তাঁর নাম হলো খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ভুল করো কেন? তিনি আমার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। আমিও তাঁর সাথে সরাসরি কাজ করেছি। খুব রাগী ও সৎ লোক। ঠিক আছে যাও।
পরেরদিন আমি ঠিক দশটায় বাংলাদেশ ব্যাংকে যাই। তবে একটু ভয়ে ভয়ে গেলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে খালেদ ভাইয়ের পিএস-এর সাথে দেখা করলাম। তিনি তাৎক্ষনিকভাবে খালেদ ভাইকে ফোন করে বলেন যে, মেলা থেকে একজন আপনার সাথে দেখা করবে। খালেদ ভাই আমাকে দেখা করার অনুমতি দিলেন। আমি ভয়ে ভয়ে যাচ্ছি, বাবা বললেন খুব রাগী, তাতে আরও ভয় বেড়ে গেলো। যাই হোক খালেদ ভাইয়ের সাথে দেখা হলো, আমার সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। তিনি হাসি মুখে আমার প্রয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি আমাকে নাস্তা খেতে বললেন এবং পাসপোর্ট ও ডলার নিয়ে নিলেন। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমার কাজ শেষ। তিনি জানতে চাইলেন, আমি এখন কোথায় যাবো এবং কিভাবে যাবো। প্রথম দেখায় খালেদ ভাইয়ের প্রতি আমার ধারনা পাল্টে গেলো। বাবাকে বললাম যে, আপনার ধারনা ঠিক নয়। বাবা হেসে বললেন, তিনিও কচি-কাঁচার মেলার সাথে জড়িত তাই তোমার সাথে রাগ বা গম্ভীর ছিলেন না।
কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের মৃত্যুর পর দাদাভাইয়ের যোগ্য উত্তরসুরী খালেদ ভাই কেন্দ্রীয় মেলার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০০০ সালে। খালেদ ভাই দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘ বিরতির পর আয়োজিত ২০০৩ সালে শিক্ষা-শিবিরে স্বরূপকাঠি সোপান কচি-কাঁচার মেলার একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আমি অংশ নিই। খালেদভাইকে তখন দেখেছি সকালে একবার আসতেন মেলা ভবনে, আবার ঠিক সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসতেন শিক্ষা শিবিরের কার্যক্রম দেখার জন্য। শিক্ষা শিবিরে অংশগ্রহণকারী ভাই-বোনদের রাতের খাবার শেষ করে তারপর বাসায় যেতেন। আমি খালেদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং বললাম আমি স্বরূপকাঠি সোপান কচি-কাঁচার মেলা থেকে এসেছি। আমি তাঁকে স্বরূপকাঠি মেলা পরিদর্শনের জন্য অনুরোধ করি। তিনি আমাকে বললেন আগামীকাল জানাবো। ঠিক তারপর দিন আমাকে তিনি ডেকে বললেনÑ আগামী মাসে যাবো স্বরূপকাঠি। তুমি তোমার মতো করে আয়োজন করো। বিশ^াস করতে পারলাম না যে, তিনি আমার কথায় স্বরূপকাঠিতে যাবেন শাখা মেলা পরিদর্শনে। অবাক যেমন হয়েছি, তেমনি আমার আরও কার্যক্রমের গতি বেড়ে গেলো। যথাসময় তিনি স্বরূপকাঠি উপস্থিত হলেন। সাধারণত গ্রামে অনুষ্ঠান হয় সন্ধ্যায়। খালেদ ভাই ঠিক তিনটায় গিয়ে বললেন এখন শুরু করো। তা না হলে আমি থাকতে পারবো না। উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে খালেদভাই পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তাই মেলার কার্যক্রমের পাশাপশি বরিশাল বিভাগের পূবালী ব্যাংকের সভায়ও অংশগ্রহণ করবেন। বিকেলের দিকে অনেক ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। অনুষ্ঠান তিনটায় শুরু করে ঝড়-বৃষ্টির জন্য বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর আবার শুরু করি অনুষ্ঠান। খালেদ ভাই শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান দেখেছেন। তিনি অনুষ্ঠান শেষে খুশি হয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য ৫,০০০/-টাকা উপহার দেন। ঢাকা এসে আমাকে একটা ব্যক্তিগত চিঠি লিখলেন যে তিনি আমার আথিতেয়তায় মুগ্ধ, সাথে স্বরূপকাঠি সোপান কচি-কাঁচার মেলার কার্যক্রমের জন্য অভিনন্দনপত্র দিয়েছিলেন। খালেদভাই, ভাবী, অঞ্জলীভাবী, আলপনা দিদিসহ ভাইবোনদের একটি দল নিয়ে আরও তিনবার তিনি স্বরূপকাঠি সফরে আসেন।
আামার বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই ঢাকায় থাকতো। তাই মাঝে মধ্যে ঢাকা আসা হতো। ঈদ, কোরবানীসহ সব উৎসবেই ঢাকায় আসা হতো। ঢাকায় আসলে মেলা ভবনে যেতাম। মাঝে মধ্যে খালেদভাইয়ের সাথে দেখার করার জন্য পূবালী ব্যাংকে যেতাম। আমার ছোট বোনের বিয়েতে খালেদভাইসহ মেলার অনেককে দাওয়াত দিয়েছিলাম। খালেদ ভাই ছিলেন খুব সামাজিক মানুষ। তিনি আমার ছোট বোনের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন।
একবার খালেদ ভাইয়ের সাথে আমি ব্যাংকে দেখা করতে গেলে খালেদ ভাই আমার শারীরিক খোঁজ খবর নেন। যেহেতু তিনি জানতেন ভুল চিকিৎসার জন্য আমার শারীরিক সমস্যা হয়েছিল তাই তিনি আমাকে আবারও নতুন করে ডাক্তার দেখানোর কথা বললেন। খালেদভাই বললেন- তুমি সন্ধ্যায় মেলা ভবনে আসো, আমি রুবী রহমানের সাথে কথা বলেছি তিনিসহ তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। যেমন কথা তেমন কাজ আমার আসতে দেরি দেখে তিনি আমাকে ফোন দিলেন বললেন যে রুবী আপা বসে আছেন। তুমি তাড়তাড়ি আসো। প্রায় একঘন্টা দেরী করে আসি। তারপরও তিনি কোন রাগ করেন নাই। আামকে সাথে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলেন। পরের দিন ব্যাংকের লোক দিয়ে আমার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করান। ডাক্তার দেখে আমাকে থেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেন। আমি খালেদ ভাইকে বললাম- আমি সি আর পিতে এর আগেও থেরাপী নিয়েছি। খালেদ ভাই আমাকে বললেন দেখি চেষ্টা করে তুমি কাল সি আর পিতে যাও। আমি মনুকে বলেছি। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সি আর পিতে থেরাপী নেওয়ার সাথে কম্পিউটার এর গ্রাফিক্সের উপর ট্রেনিং নিই। থেরাপি নেওয়ার পরে খালেদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি ব্যাংকে। খালেদ ভাই আমাকে বিকালে মেলা ভবনে আসতে বললেন। খালেদ ভাই আমাকে কেন্দ্রীয় মেলায় কাজ করার জন্য বলেন। আমিও সেইভাবে কাজ শুরু করি কেন্দ্রীয় মেলায়। দীর্ঘ সময় খালেদ ভাইয়ের সাথে কাজ করার সুযোগ হলো। খুব কাছ থেকে খালেদ ভাইকে দেখার এবং কাজ করার মাধ্যমে অনেক কিছু শিখেছি। খালেদ ভাইয়ের সাথে আমি বিভিন্ন শাখা মেলা সফর করি, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। খালেদভাইকে অনেকে বলেন তিনি খুব গম্ভীর, আসলে আমি কোনদিন তাঁকে গম্ভীর দেখি নাই। তিনি ছিলেন শিশু বান্ধব, তাই শিশুদের সাথে তাঁর সর্ম্পক ছিল খুব ভালো। সব শিশুরাই খালেদ ভাইকে পছন্দ করতো।
খালেদ ভাইয়ের সাথে আমার সর্ম্পক ছিল খুব আন্তরিক। আমার বিয়ের পর মৌসুমীকে দেখতে খালেদভাই সহ মেলার ভাই-বোনেরা আমার বাসায় যান এবং আমাদের দোয়া করে আসেন। আমার মেয়ে হওয়ার পর খালেদ ভাই আমাকে ফোনে অভিনন্দন জানান এবং বাসায় গিয়ে আমার মেয়ে শ্রেষ্ঠাকে দোয়া করেন। খালেদ ভাই দেশের বাইরে গেলে কোনদিন খালি হাতে আসতেন না। হয় আমার জন্য অথবা শ্রেষ্ঠার জন্য উপহার থাকতো। সালটা মনে নাই সম্ভবত ২০১২/১৩ সালে খালেদভাই সিঙ্গাপুরে তাঁর মেয়ের বাসায় বেড়াতে যান। প্রায় এক মাস ছিলেন। সিঙ্গারপুর থেকে এসে আমাকে ফোন করলেন যে, তুমি কি আজ মেলা ভবনে আসবে? বল্লাম হ্যাঁ আসবো। আমি বিকালে মেলায় আসবো। ঠিক ৩টায় আমাকে আবার ফোন দিলেন যে তুমি কি মেলা ভবনে আছো? বল্লাম আছি। ও আচ্ছা আমি আসছি। অনেক দিনপর সিঙ্গাপুর থেকে তিনি ঢাকা এসেছেন। আমিও মনে মনে ভেবেছিলাম যে তিনি উপরে যখন বসবেন তারপর দেখা করবো। কিন্তু না খালেদভাই সোজা রুমে এসে আমার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছেন আমি কি করি। আমি অবশ্য একটু কাজ নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম। তাই খেয়াল করি নাই। মনে করেছিলাম যে তিনি মেলা ভবনের ৩য় তলায় বসবেন। উনি যে আমার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন তা আমি খেয়াল করি নাই। যখন খেয়াল করলাম খালেদভাই আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। উঠে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে উঠতে দিলেন না। খালেদ ভাই সবসময় কচি-কাঁচার মেলার ব্যাগ ব্যবহার করতেন। তিনি ব্যাগ খুলে একটা ব্লেজারের কাপড় বের করে বললেন, দেখতো কেমন হয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, আমাকে ব্লেজারের কাপড় কেন দেখাচ্ছেন? দেখে বল্লাম ভাল ভাই। পছন্দ হয়েছে কি না জানতে চাইলেন? আমার কোন ভাষা ছিল না। কি বলবো। তিনি বললেন আমি তোমার জন্য সিঙ্গাপুর থেকে এনেছি। তুমি ব্লেজারটা আজকেই বানাতে দিবে। তবে ট্রেইলারের খরচ ফিফটি ফিফটি। আমাকে জানাবে কবে ব্লেজার দিবে ট্রেইলার? ঠিক ব্লেজার দেওয়ার আগের দিন তিনি ঠিকই আমাকে মজুরির ৫০% টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেন। এরপর যতবারই খালেদ ভাই দেশের বাইরে গিয়েছেন ততবারই উপহার নিয়ে এসেছেন। শেষের বার যখন ভাবীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গেলেন তখনও তিনি শ্রেষ্ঠার জন্য উপহার নিয়ে এসেছেন। দেশের বাইরে যখন যেতেন সব-সময় তিনি আমাকে ফোন করতেন। মেলার খোঁজ-খবর নিতেন। আমার শরীর কেমন খোঁজ নিতেন। করোনাকালীন খালেদ ভাই আমাকে প্রায় প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ নিতেন বিশেষ করে শ্রেষ্ঠার। করোনার আগে শ্রেষ্ঠা অসুস্থ হলে খালেদ ভাই আমাকে কোন ডাক্তার দেখাবো সেই পরামর্শ দিয়েছেন, শুধু তাই না তিনি শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছেন। কোথাও কোন সমস্যায় পড়লে খালেদ ভাই সব-সময় সাথে থাকতেন এবং সঠিক পরার্মশ দিতেন। খালেদ
ভাইয়ের অনেক ব্যক্তিগত কাজ করে দিয়েছি। কেননা খালেদ ভাই আমাকে ভরসা করতেন। তাই তাঁর অনেক ব্যক্তিগত কাজে আমি জড়িত ছিলাম। কোন দিন প্যারা দিতেন না। কোন কিছু না বুঝলে সাথে সাথে তা বুঝিয়ে দিতেন। বিরক্ত হতেন না। ফোন দিয়ে শুরুতেই বলতেন, না না আমি এমনি ফোন দিয়েছি। কখনও অর্ডার করেন নাই। একজন মহান মানুষের যে সব গুণাবলী থাকা দরকার ছিল তার কোন অংশই কম ছিল না খালেদ ভাইয়ের। সৌভাগ্য আমার খালেদভাইয়ের মতো উদার মনের মানুষের সাথে মিশতে পারার জন্য।
খালেদ ভাইয়ের সাথে আমার অনেক অনেক স্মৃতি! যেদিকে তাকাই শুধুই খালেদ ভাইকে দেখি। দীর্ঘসময় ধরে খালেদভাইয়ের সাথে কাজ করেছি, সময় কাটিয়েছি। স্মৃতিচারণ করতে গেলে হয়তো দিস্তায় দিস্তায় কাগজ শেষ হয়ে যাবে। এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারি না। মেলার বিশেষ কার্যক্রমে তিনি সদস্যদের মতামত নিতেন। তাঁর কোন সিদ্ধান্তই ভুল হতো না। যেহেতু আমি মেলার প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলাম তাই, কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার সাথেও আলাপ করতেন।
মেলার মিলনায়তন সংস্কারের কাজ চলছিল। ডাচ বাংলা ব্যাংকের অর্থায়নে। মিলনায়তনের প্রবেশ পথের দরজা মাপের চেয়ে ছোট করে দরজা তৈরী করা হয়েছে। মিলনায়তনের প্রবেশের সেই ছোট দরজা স্থাপন করা হচ্ছিল। তা দেখে আমি খালেদ ভাইকে ফোনে জনালাম। খালেদ ভাই আমার উপর রাগ করে বললেন, তুমি কি ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ার যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করছে। ঐদিন বিকালে খালেদভাইয়ের মেলা ভবনে আসার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি তা না করে এক থেকে দেড়ঘণ্টার মধ্যে মেলায় চলে আসেন। এসেই তিনি মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। তিনি নিজেই প্রবেশ পথের দরজা দিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় দেখলেন আমি যা বলেছিলাম তাই ঠিক। সাথে সাথে খালেদভাই ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন দিয়ে বললেন দরজা ছোট হয়েছে তাই কাজ বন্ধ করে দিতে বলেন। পরে অবশ্য ইঞ্জিনিয়ার ঠিক করে দিয়েছিলেন। খালেদভাই আমার রুমে এসে বললেনÑ কি খাবে? আমি বললাম, না মাত্র দুপুরের খাবার খেয়েছি। জানতে চাইলেন আমি ইঞ্জিনিয়ারকে কিছু বলেছিলাম কি না? বললামÑনা। খালেদ ভাই বললেন ঠিক আছে। এরপর থেকে আমাকে জানাবে। ধন্যবাদ দিতে কার্পণ্য করেননি। এই হলো খালেদ ভাই।
আমি কোন দিন মেলায় আমার জন্মদিন পালন করি নাই। ঘরোয়াভাবে বাসায় পালন করি। মা, বাবা, শ্রেষ্ঠা ও মৌসুমীর কারণে আমার জন্মদিন পালন করতে হয়। জন্মদিন পালন মানেই বয়স বেড়ে যাওয়া। যা আমার ভালো লাগে না। ৩১ জুলাই আমার জন্মদিন তাই মেলার সব কাজ দ্রুত শেষ করি। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি খালেদ ভাই মেলা ভবনে আসলে তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার কথা বলবো কিন্তু সেই দিন খালেদ ভাই মেলাভবনে এসেছিলেন প্রায় ৭টার পর আলপনা দিদিসহ। মেলা ভবনের আসার পর আমি তৃতীয় তলায় খালেদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম বলার জন্য যে আমাকে এখন বাসায় যাওয়া দরকার। খালেদ ভাই বললেন, ঠিক আছে যাও, তিনি আরও জানতে চাইলেন যে, আমার বাসায় কোন সমস্যা আছে কি না? বললাম না। ঠিক আছে উপরে যখন এসেছো কফি খেয়ে যাও। কফি খাওয়ার সময় আলপনা দিদি বললেন, খালেদ ভাই আজ শাকিলের জন্মদিন। তাই বাসায় যাবে। খালেদ ভাই বললেন, আলপনা তুমি কি ভাবে জানো। তোমাকে কি শাকিল বলেছে। দিদি বললেন না। আমি ফেইজবুকে দেখেছি। আমি একটু লজ্জা পাচ্ছিলাম। খালেদ ভাই সাথে সাথে বললেন, আগে জানলে তো শ্রেষ্ঠাকে মেলায় আসতে বলতাম আর ছোট করে আমরাই জন্মদিন পালন করতাম। আর কি করা! ঠিক আছে বাসায় যাও। তখন রফিককে ডেকে টাকা বের করে খালেদ ভাই বললেন শাকিলকে একটা কেক কিনে দাও। আমার তরফ থেকে তোমাকে জন্মদিনে কেক উপহার দিলাম। শ্রেষ্ঠাসহ সবাই আনন্দ করো
বম্বে সুইটস কচি-কাঁচা সঙ্গীত প্রতিযোগিতার ফাইনাল হওয়ার পর দিন মনে হলো আমার একটু বিশ্রাম দরকার। খুব পরিশ্রম হয়েছিল। খালেদ ভাই ও আলপনা দিদি ৩য় তলা থেকে নিচে নেমে এসেছেন গাড়িতে উঠবেন তখন আমি মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম। খালেদ ভাই যখন দেখলেন আমি মাঠে দাঁড়িয়ে আছি তিনি গাড়িতে না উঠে আমার কাছে এসে জানাতে চাইলেন তুমি কি কিছু বলবে? আমি বললাম ভাইয়া আমি আগামী কাল আসতে চাচ্ছি না। ও কেন? বাসায় কাজ আছে ব্যক্তিগত। খালেদ ভাই বললেন ও তুমি না আসলে তো আমারও কোন কাজ হবে না। ঠিক আছে তাহলে আমিও কাল আসবো না। আলপনা তোমার আসার দরকার নাই। শাকিল তুমি দীপককে ফোন করে বলে দাও না করে দাও আগামীকাল যেন না আসেন। শহীদকে ডেকে বললেনÑ যেহেতু আমরা কেউ আগামী কাল আসবো না। তোমরা সব গেট বন্ধ রাখবে।
খালেদ ভাইয়ের সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয় যেদিন, সেই ঠিক মাগরিবের আযানের ২০মিনিট বাকী। ফোন দিয়ে বল্লেন তুমি কি খুব ব্যস্ত। বল্লাম না ভাই। তাহলে একটু উপরে আসো। আমি সাথে সাথে উপরে গেলাম। দেখলাম সোফায় খালেদভাই, আলপনা দিদি, ঘোষাল দা এবং তার ছেলে বসে আছেন। আমি যাওয়ার সাথে সাথে তিনি সোফা ছেড়ে উনার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমিও একটা চেয়ার নিয়ে বসলাম। খালেদভাই বললেন শাকিলকে কফি দাও। আলপনা দিদিও সোফা থেকে উঠে আসলেন এবং আমার পাশে একটি চেয়ার নিয়ে বসেলন। শ্রেষ্ঠার খোঁজ-খবর নিলেন অনেক কথা হলো। এরমধ্যে মাগরিবের আযান শুরু হয়। খালেদভাই নামাজে দাঁড়াবেন তাই আমি নিচে চলে আসছিলাম কিন্তু খালেদ ভাইরের জন্য পারলাম না। তিনি সাথে সাথে আমাকে বললেন তুমি বসো। নামাজ পড়ে একসাথে নাস্তা করবো। শহীদকে ডাক দিয়ে বললেন শাকিল তো প্রতিদিন উপরে আসে না। যাও মোগলাই নিয়ে আসো। নামাজ পড়া শেষে শহীদ আমাদের নাস্তা দিলো। নাস্তা খাওয়া শেষ করেই আমি আবারও চলে আসছিলাম। তখন খালেদভাই আমাকে বললেন কফিটা খেয়ে যাও। দিদি হাসতে হাসতে বললেন শাকিলতো একটু আগে কফি খেয়েছে। খালেদভাই বললেন তাতে সমস্যা কি? ও আবার কফি খাবে। কফি খেয়ে আবার নিচে আসলাম। খালেদ ভাই বাসায় যাওয়ার পথে আবার আমার রুমে এসে বললেন, আমার শরীরটা ভালো না। আমি চলে যাচ্ছি। আলপনাকে ঘোষালদা নামিয়ে দিবেন। তোমার কোন কাজ না থাকলে তুমিও চলে যাও। তোমার বাসা অনেক দূরে। আগামীকাল কার্যনির্বাহী সভা আছে। আগামীকাল দেখা হবে বলে চলে গেলেন। পরের দিন কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়ে ঠিকই কিন্তু খালেদভাই আসতে পারেন নাই। অসুন্থ হয়ে পড়েন। মেলা থেকে খালেদভাইকে দেখতে যায়। আমার যাওয়া হয় নাই। কিন্তু খালেদ ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। মিটিং কে কে উপস্থিতি ছিলেন? কি কি সিদ্ধান্ত হয়েছে? কে সভাপতিত্ব করেছেন? আরও অনেক কথা হয়েছে। মনে করে ছিলাম বাসায় দেখতে যাবো খালেদ ভাইকে। যাওয়া হয় নাই। সেইদিনই খালেদভাই আমাকে আবার ফোন করেন। ঐ ফোন ছিল আমার সাথে খালেদভাইয়ের শেষ কথা বলা। আর কোন কথা হয় নাই। তার সপ্তাহখানেক পর পর দুবার খালেদভাইয়ের করোনা টেস্ট করানো হয়, রির্পোট নেগেটিভ আসে কিন্তু খালেদভাইয়র দুর্বলতা কাটছিলো না। এত দুর্বল শরীর নিয়েও খালেদভাই তারপর দুইদিন মেলায় এসেছিলেন, জানুয়ারি মাসের শেষর দিকে বাথরুমে পড়ে খালেদভাইয়ের মাথা ফেটে যায়, সেলাই লাগে। হাসপাতালে যেতে হয়।
মেলার .৫ শতাংশ জমি রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য খুব দৌড়ঝাপ শুরু করি। একটার পর একটা ঝামেলা শুরু হলো রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে না। মেলার সহ-সভাপতি খোন্দকার মো. আসাদুজ্জামান তিনিও খুব চেষ্টা করছেন। আমি আর দিদি কতবার যে ডিসি অফিসে যাই তার হিসেব নাই। যাই হোক আল্লাহতালার অসিম রহমতে শেষ পযর্ন্ত জমি রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয়, ঐ মুর্হুতেই সাথে সাথে আমি আলপনা দিদিকে জানাই যে জমির রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। তখন হাসপাতালে খালেদভাইয়ের পাশে ২৪ঘন্টার মধ্যে ১৬ ঘন্টাই আলপনা দিদি দেখাশুনা করতেন খালেদ ভাইয়ের। আলপনা দিদিকে জমি রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে ফোনে জানানোর পর দিদি সাথে সাথে খালেদভাইকে জানান। শেষ পর্যন্ত খালেদভাই জেনে যেতে পেরেছিলেন যে, জমি রেজিষ্টেশন হয়েছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ভোর রাতে দিদি আমাকে ফোন করে বলেন, শাকিল সব শেষ। কিছু বোঝার
আগেই দিদি আবারও বললেন শেষ। খালেদভাই আর নাই। খালেদ ভাইকে নিয়ে আসা হবে মেলা ভবনে। মেলায় এসে অপেক্ষায় ছিলাম খালেদভাইয়ের জন্য। শেষপর্যন্ত এসেছেন নিথরদেহ নিয়ে। শুয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। আমাকে ডাকলেন না কাছে। কোনকিছু জানতে চাইলেন না। আমি কিভাবে বাসায় যাবো, কখন যাবো তাও কিছু বলে যান নাই। যাওয়ার সময় বলেও গেলেন না। ভুলতে পারি না। যেদিকে তাকাই শুধু আপনাকে দেখি খালেদ ভাই। আমার মনে হয় আপনিও আমাদেরকে দেখছেন। কোনদিন ভুলতে পরবো না আপনাকে খালেদভাই।
0 Comments