আদর্শ বাঙালী জননী
রোকনুজ্জামান খান
বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে আমার পরিচয় বৃটিশ আমল থেকে কোলকাতায়। কিন্তু তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ ঘটেছে পঞ্চাশের দশকে। তারাবাগ নামের একটি বৃক্ষরাজিশোভিত অঞ্চল (বলা চলে একটি সবুজ বাগানবাড়ী)। একটি পুকুর, কিছু আম-জাম-কুল আর কলা গাছ ঘেরা এই সবুজ পরিবেশে একটি একতলা বাসভবন। আর এটাই সুফিয়া কামালের বাসভবন। একটি ঘটনা আজও চোখের সামনে ভাসছে। বেগম সুফিয়া কামাল তার বাসভবনের বারান্দায় বসে মুড়ি ভাজছেন। বাবার আঙিনায় তার দেয়া মাদুর বিছিয়ে বসেছে একদল শিশু-কিশোর, সংখ্যা ১৫/১৬জন। আর ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মুতী এবং এম এ ওয়াদুদ (পূর্ববঙ্গ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যবস্থাপক)। বেগম সুফিয়া কামালের বাসভবন প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই ক্ষুদ্রতম এক সভায় প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের দিনের বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম শিশু-কিশোর সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা। সে আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা। দিনটি ছিল ৫ অক্টোবর ১৯৫৬ সাল। বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর টাটকা গরম মুড়ি দিয়ে আমাদের আপ্যায়িত করলেন। কচি-কাঁচার সঙ্গে সেই থেকে গড়ে উঠেছে তাঁর মধুর সর্ম্পক। সেদিন থেকে তিনি মেলার সদস্যদের পরম স্বজন। সবার খালাম্মা।
মায়ের পরম স্নেহে সিক্ত করে এই ছোটখাটো মানুষটি কচি-কাঁচার মেলাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন দীর্ঘ ৪০ বছর। কত কত ঝড়-ঝঞ্চা এই সংগঠনের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে তীব্র আঘাত হেনে। আমাদের সঙ্গে তিনিও ঝড়ের মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছেন। ১৯৭১ সালে ২৭ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের পাশে অবস্থিত মেলার কার্যালয় ও শিশু পাঠাগার হানাদার পাকবাহিনী ধ্বংস করে দেয়। বেগম সুফিয়া কামাল এ খবর শুনলেন। তাঁর চোখ দু’টি অশ্র“সজল হয়ে উঠলো। ৪০ বছর আগে তাঁরই বাসার আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠিত কচি-কাঁচার মেলার নিজস্ব ভবনের উদ্বোধন হলো গত ২১ এপ্রিল। উদ্বোধন করলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সেদিনর সুপ্রিম কোর্টর প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান। বেগম সুফিয়া কামাল দারুন অসুস্থ শরীর নিয়েও ছুটে এলেন অনুষ্ঠানে। ভাষণ দিলেন কণ্ঠের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে।
কচি-কাঁচার মেলার কথা শুনলে আজও তিনি ইমোশনাল হয়ে ওঠেন। এই সংগঠনের বিভিন্ন ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বৃদ্ধ বয়সেও ছুটে বেড়িয়েছেন কক্সবাজার থেকে পটুয়াখালী, বগুড়া, ইশ্বরদী, ভেড়ামারা,, কুষ্টিয়া, মুন্সীগঞ্জ, লৌহজং, চারিগ্রাম, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, ভৈবর, মতলম, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন শহর-বন্দর। পল্লীর কচি-কাঁচার তাকে তাদের মাঝে পেয়ে উদ্বেলিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছে। কুমিল্লা আর চাঁদপুরে গিয়েছেন তিনি বহুবার। অন্তরের দরদ মিশিয়ে কচি-কাঁচারা তাঁকে খালাম্মা ডেকে পরিতৃপ্ত হয়েছে। তিনি আদর করে ওদের কাছে টেনে নিয়েছেন। মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন ওদের মিষ্টি কণ্ঠের গান। ওদের আবৃত্তি। দেখেছেন নৃত্য। আর মাঠে দেখেছেন ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ক্রীড়ানুষ্ঠান। তিনি হেঁটেছেন কচি-কাঁচাদের মিছিলে। ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাস। কচি-কাঁচার মেলার জেলা সম্মেলনে তিনি চলেছেন সিলেটে। ভোরে সিলেট ষ্টেশনে নেমেছেন। সিলেটের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আমিনুর রশিদ চৌধুরী তাঁর জন্য গাড়ী পাঠিয়েছেন। তাঁর সামনে কচি-কাঁচার দল এবং কর্মী দাঁড়িয়ে। বেগম সুফিয়া কামাল গাড়িতে উঠলেন না। শিশু-কিশোর আর কর্মীদের সঙ্গে মিছিলের পুরোভাগ থেকে হেঁটে চললেন কিংস ব্রীজ পর্যন্ত। ১৯৬৭ সালের মে মাসে বগুড়ায় অনুষ্ঠিত উত্তরবঙ্গ কচি-কাঁচার মেলা সম্মেলনে এসেও তিনি ষ্টেশন থেকে মিছিলে হেঁটে চললেন হল পর্যন্ত। আর মানিকগঞ্জের চারিগ্রাম (কবি মঈনউদ্দিনের জন্মভূমি) সম্মেলনে গিয়ে লঞ্চঘাট থেকে দুইমাইল পথ মিছিলের সঙ্গে হেঁটে চললেন সুফিয়া কামাল। সঙ্গে ছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, ছড়াকার হোসনে আরা, পাকিস্তান গণপরিষদের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী রোকাইয়া আনোয়ার, লেখিকা বেগম জোবেদা খানম, বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম, ডঃ আবদুল্লাহ আল মুতীসহ ঢাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সেই সঙ্গে ঢাকা ও চারিগ্রামের প্রায় চারশত কচি-কাঁচার সদস্য ও স্থানীয় ব্যক্তিবৃন্দ। দিনটা ছিল ১৯৬৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। শীতকাল চারিগ্রামের পথে যেতে সরিষা ফুলের স্নিগ্ধ হলুদ পুস্পরাজি যেন আহ্বান জানাচ্ছিল বার বার গ্রাম বাংলার হৃয়দস্পর্শী প্রকৃতিকে দু’চোখ ভরে দেখার। ‘আমার বাড়ি আইসো বন্ধু/বসতে দেব পিঁড়ে/জলপান যে করতে দেব/শালি ধানের চিড়ে’। না শালি ধানের চিড়ে নয় দু’মাইল পথ হেঁটে এসেও পল্লীর প্রাকৃতিক দৃশ্যে মুগ্ধ অভিভূত সুফিয়া কামাল সবার সঙ্গে স্বাধ গ্রহণ করলেন দুধ লাউ-এর। মুহূর্তের ভেতর চারিগ্রাম সেই দুধ লাউ-এর প্রশংসায় উচ্চকিত হয়ে উঠলেন।
শ্রীমঙ্গলে লাইয়াছড়া ফরেষ্ট বাংলো। শ্রীমঙ্গল কচি-কাঁচার মেলা সম্মেলন শেষে কচি-কাঁচারা এখানে আয়োজন করেছে বনভোজনের। শিশু-কিশোর আর তরুণ কর্মীদের সঙ্গে এসেছেন সুফিয়া কামাল। বাংলোটি বেশ উঁচুতে, একটি টিলার মাথায়। ছোট্ট সেই মানুষটি দিব্যি তরতর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে গেলেন। আর কচি-কাঁচারা তাকে এত কাছে এমন একান্তভাবে পেয়ে কি খুশি! সবাই গেলেন খাসিয়া পল্লীতে। সে পল্লীও টিলার উপর। টিলার মাথায় খড় আর বনের কাঠ দিয়ে তৈরী গোলাকৃতি ঘর তুলে সেখানে আদিবাসী খাসিয়ারা বাস করে। সিলেট অঞ্চল খাসিয়া পানের বেশ কদর। সুফিয়া কামাল খাসিয়া দলপতির ঘরে বসলেন। খাসিয়া মেয়েদের দেয়া পান খেলেন। ওদের সঙ্গে আলাপ করলেন। শিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা এটা। শ্রীমঙ্গলের তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়া তাকে একটুও কাবু করতে পারলো না। শ্রীমঙ্গল থেকে যাওয়া হলো মৌলভীবাজার। রাতের খাওয়া শেষে একটি রিজার্ভ বাসে করে আবার শ্রীমঙ্গলের পথে যাত্রা। হঠাৎ মাঝপথে বাসটি গেল বিকল হয়ে। একটি বিরাট মাঠের মাঝে। দূরে কিছু কিছু টিলা আর চারদিকে ফাঁকা বিস্তীর্ণ মাঠ। ডিসেম্বরের হাড় কাপানো শীত। রাত তখন দশটার উপরে। বাসের ভিতরে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, নূরজাহান বেগম এবং ঢাকার বেশ কিছু কর্মী শিশুসহ শ্রীমঙ্গলের কচি-কাঁচারাও ছিল। আজকের শিল্পী হাসেম খান, শামসুজ্জামন খান, শাহাদৎ চৌধুরী সবাই বাসে বন্দী। সুফিয়া কামাল সবাইকে সতেজ রাখার চেষ্টা করছেন নানা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে। সি এ্যান্ড বি-র এক ইঞ্জিনিয়ার যাচ্ছিলেন মৌলভীবাজারের দিকে। তারই সহযোগিতায় রাত বারোটায় পাওয়া গেল একটি পিক-আপ ভ্যান। ড্রাইভারের পাশে সুফিয়া কামাল, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, নূরজাহান বেগম আসন নিলেন। পেছনে খোলা জায়গায় যেখানে ১৪/১৫ জন কোন প্রকারে দাঁড়াতে পারে সেখানে ২৮জন দাঁড়িয়ে তীব্র শীতে স্বাদ নিতে নিতে শ্রীমঙ্গল ফিরে এলো। এই ২৮জনের ভিতর আমিও একজন। রাত তখন প্রায় একটা। সুফিয়া কামাল তখনো সতেজ, তাঁর মুখে হাসি। বললেন, জীবনে একটা অভিজ্ঞতা হলো। তবে চলার পথে এমন ঘটেই থাকে। একবার যাওয়া হচ্ছে মতলব কচি-কাঁচার মেলার সম্মেলনে যাওয়ার পথে চাঁদপুর কলেজ মাঠে শুরু হয়েছে মেলার শরীরর্চ্চা অনুষ্ঠান। সুফিয়া কামাল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি, তিনি ভাষণ দিলেন উপস্থিত প্রায় দেড় হাজার দর্শক শ্রোতাকে শিশু-কিশোর আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে।
বেশ কিছুদিন পর আমাদের কাছে খবর এলো। একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা উষ্মা প্রকাশ করেছেন সুফিয়া কামালের বক্তৃতার ব্যাপারে। তিনি না-কি আল্লাহর বানী কোরানের সঙ্গে মানুষের লেখার কবিতার তুলনা করেছেন। তিনি কচি-কাঁচার মেলার কাছে কৈফিয়তও চেয়েছেন লোক মারফত। কথাটি বেগম সুফিয়া কামালকে জানানো হলো। তিনি শুনে একটুও উত্তেজিত হলেন না। আমাকে বললেন, সেই ভদ্রলোককে বলবে ইসলাম সর্ম্পকে আমার জ্ঞান তার চেয়ে কম নয় বরং বেশী। আসলে রাজনৈতিক নেতার কানে সুফিয়া কামালের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল।
আর্দশ বাঙালী জননী সুফিয়া কামাল। আমি ৩/৪ বছর আগেও দেখেছি এই বয়সেও তিনি সবক’টি রোজা রাখছেন। শুধু তাই নয়, রোজা রেখেও তিনি বাসার সবার জন্য রান্না করছেন। তিনি রান্নায় ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। সুফিয়া কামাল গোটা রুই মাছ রান্না করতে পারতেন। কোলকাতায় এক সময় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে খুবই মধুর আত্মিক সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল সুফিয়া কামালের। প্রতি রোববার ছুটির দিনে সুফিয়া কামাল তার শিশু কন্যা আমিনাকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন নাসিরউদ্দিন সাহেবের বাসায়। সেখানে বিশেষ বিশেষ রান্নার আয়োজন হতো। মিসেস নাসিরউদ্দিনকে নিয়ে সেইসব রান্নায় মেতে উঠতেন সুফিয়া কামাল। আজকের দিনের মেয়েরা চাইনিজ বা থাই রান্নায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। এসব রান্নার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খোলা হচ্ছে ইদানিং। কিন্তু সুফিয়া কামালের মত আস্ত রুই মাছ রান্না ক’জন জানেন?
সুফিয়া কামাল দেশের সর্বস্তরে বেড়িয়েছেন শিমুদের ডাকে। সমাজের আহ্বানে সাড়া দিয়ে। কিন্তু ঘর সংসারের কোন কাজ তাতে ব্যাহত হয়নি। ঘরে থাকলে নিজে রান্না করেছেন। ছেলেমেয়েদের জামা সেলাই করেছেন। এমন কি আমদের পরম শ্রদ্ধায় কামালউদ্দিন খান-এর গায়ের ফতুয়াও তিনি সেলাই করেছেন। আবার লেখালেখির চর্চাও তার থেমে থাকেনি। অনেক সময় দেখা গিয়েছে সুফিয়া কামাল রান্না চড়িয়ে চুলার পাশে বসে লিখছেন।
যিনি দেশের শিশুদের দিকে দৃষ্টি রাখছেন, চোখ রাখছেন মহিলা সমাজের সমস্যার প্রতি, দেশের বুক জুড়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জিইয়ে রাখার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, দুস্থদের সেবায় বস্তিতে বস্তিতে ঘুড়েছেন। বক্তৃতা করতে গিয়ে ভাবাবেগে তার চোখ দিয়ে অশ্র“ ঝড়ে পড়ছে- সেই সুফিয়া কামাল মহাশক্তিধর স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মুখের উপর কড়াকথা বলতেও দ্বিাধা করেননি। ঘটনাটি খুলেই বলা যাক। ১৯৬৪ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ছাত্ররা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে আইযুব সেনাদের শাসনের যাঁতাকলে পড়ে। মোনায়েম খান তখন এ অঞ্চলের গর্ভণর। আইয়ুব এসেছেন ঢাকায় ছাত্র অসন্তোষজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলায়। ঢাকার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ডাকা হয়েছে আইয়ুব খানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবার জন্য। বেগম সুফিয়া কামাল তাদের ভেতর একজন। আলোচনা চলেছে। বেগম সুফিয়া কামাল আইয়ুব খানকে উদ্দেশ করে অনুরোধ জানালেন, আপনি তো তাসখন্দে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে বসে যুদ্ধজনিত উভয় দেশের এতবড় সমস্যার সমাধান করে এলেন। এখানকার সমস্যা তো সেই তুলনায় কিছুই না। আপনি এ সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যান।
0 Comments