খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
কবি সুফিয়া কামাল। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আপনজন। আমাদের খালাম্মা। আজ থেকে শতবর্ষ আগে যখন মায়ের কোল উজ্জ্বল করে পৃথিবীতে এসেছিলেন, তখন পুত্র সন্তানদের সমাদর বেশী। মেয়েদের লেখাপড়া, খেলাধুলা সীমিত, প্রায় নিষিদ্ধ। বাড়ীর চার দেয়ালের মধ্যে যেটুকু সম্ভব। গৃহ মেয়েদের, তাই তারা গৃহিণী। বহিরাঙ্গন ছেলেদের। উচ্চবংশে জন্মেছিলেন বলে সমাদর পেয়েছেন। কিন্তু সীমিত অধিকারের গন্ডি পেরোনো সমাজ স্বীকৃত ছিল না।
সেদিনের সেই কন্যা সন্তানটি সামাজিক প্রতিকুলতার মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠলেন। বড় হলেন। মা হলেন। শুধু সন্তানের মা নয়, তিনি হয়ে উঠলেন সমাজের মা। জনমানুষের মা। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কম ছিল। কিন্তু শিক্ষা আর প্রজ্ঞা সমার্থক নয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ অনেক বড় মানুষের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন ছিল না। কিন্তু প্রতিভা আর প্রজ্ঞার আলোকচ্ছটায় তারা সমাজকে আলোকিত করেছেন। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন তেমনি একজন ক্ষণজন্মা।
খালাম্মার চিন্তা-চেতনা, পদচারণা এতই বহুমাত্রিক ছিল যে, সংক্ষেপে তার মূল কথাটাও বলা যায় না। শততম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের সাথে সাথে দু’একটি বিষয়ের অবতারণা করবো মাত্র। প্রথমে বলবো শিশু-কিশোরদের নিয়ে তার ভাবনার কথা। সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে শিশুদের মানস বিকাশ, শরীরচর্চার মাধ্যমে তাদের সুস্বাস্থ্য গঠন, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা, আবহমান বাংলার ঐত্যিহ্যের সাথে নবপ্রজন্মের বন্ধন সৃজন, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি-এমনি সব কর্মপ্রয়াস পরিচালনার জন্য তৎকালিন প্রাজ্ঞ মনিষীদের চিন্তাপ্রসূত একটি শিশু-কিশোর প্রতিষ্ঠান জন্ম নিল ৫ অক্টোবর ১৯৫৬ সনে। কবি সুফিয়া কামালের গৃহ প্রাঙ্গণে। তাঁরই মাতৃক্রোড়ে লালিত হতে লাগলো এই নবজাতক প্রতিষ্ঠান কচি-কাঁচার মেলা। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ সন পর্যন্ত আমি এই সংগঠনের শিশু-আহ্বায়ক ছিলাম। তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, স্নেহ পেয়েছি, চলার পথে দিক দর্শন পেয়েছি। সে দর্শনের মূল কথা, মানুষ মানুষের জন্য, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা মা-য়েরই দুঁটি রূপ। মানুষ হতে হলে মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে হবে। খালাম্মার এই আদর্শকে ধারণ করে আজো শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করে চলেছে কচি-কাঁচার মেলা।
সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আরো একটি ঘটনা উল্লেখ করবো। তখন পাকিস্তান আমল। দেশের প্রসিডেন্ট ছিলেন আইউব খান। দীর্ঘ ও সুঠাম দেহী। দেশের সেনাপ্রধান ছিলেন। সামরিক আইন দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষরতা দখল করেছিলেন। রাশভারি মানুষ। একবার এসেছিলেন তৎকালিন পূর্ব-পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) সফরে। এসে একটি সভা ডেকেছিলেন স্থানীয় সুশীল সামাজ প্রতিনিধিদের। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী-পটুয়া, সাংস্কৃতিক-সামাজিক ব্যক্তিত্ব, সবাই আমন্ত্রিত। পাকিস্তানী নেতারা ছিল বাঙালী বিদ্বেষী। আইউব খানও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবু দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে সভা ডেকেছেন বলে আমন্ত্রিতরা এসেছেন। ভালো মন নিয়েই সবাই এসেছেন। ভালো কিছু শোনার জন্য। সভা শুরু হলো। আইউব খান তার ভাষণ শুরু করলেন। এক পর্যায়ে বাল্লেন, “ইহাঁ কা আদমীলোগ হাইওয়ান হ্যায়” অর্থাৎ “এখানকার মানুষেরা সব জন্তু-জানোয়ার”। সভাস্থলে থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগলো। মর্মজ্বালায় জ্বলে উঠেছিল সবাই। কিন্তু প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছিল না কেউ। ছিপছিপে গড়নের মধ্যমাকৃতির মাঝ-বয়সী একজন মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। অত্যন্ত সাবলিলভাবে প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “তব তো আপ হাইওয়ান কা সদর হো” অর্থাৎ ‘তাহলে তো আপনি জন্তু-জানোয়ারদের প্রেসিডেন্ট’। সভাস্থলে পিনপতন নিরবতা। সবাই শংকিত, না জানি এ মহিলার ওপর কি বিপদ নেমে আসে। কিন্তু বক্তা ছিলেন নিঃশঙ্কচিত্ত, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মসম্মানী। আইউব খানের ফর্সা মুখমন্ডল রক্তিম হয়ে উঠলো। রাগে তার বিশাল বপুটি বুঝি কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু জবাব তার ছিল না। বাঙালীদের অপমান করতে চেয়েছিলেন । তাকেই অপমান হজম করে ফেলতে হল। ছোটখাটো গড়নের সেই মহিলাই ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। অসীম সাহসিকতায় সেদিন তিনি মানুষকে মানুষের আসনে বসিয়েছিলেন। বাঙালীর প্রতিবাদি কণ্ঠস্বর হয়েছিলেন। সেদিন থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালীর জননী সাহসিকা।
0 Comments