Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

কচি-কাঁচাদের সাথে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান


                                       -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের পদচারণা সমাজের বিভিন্ন অঙ্গণে। তিনি একজন জ্ঞানতাপস অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। দু’তিন প্রজন্মের শিক্ষক তিনি। তিনি একজন সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সমালোচক। তিনি ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক। সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সমাজের বিবেক, মানুষের কণ্ঠস্বর।

প্রবীণ এই জ্ঞানতাপস যেমন বিদগ্ধজনের নমস্য ব্যক্তিত্ব, তেমনি শিশু-কিশোরদেরও অতি প্রিয়জন। ভার-ভারিক্কি মানুষটি যেভাবে শিশু-কিশোরদের সাথে মিশে যেতে পারেন, তা ভাবতে অবাক লাগে। শিশুদের অকৃত্রিম সরলতা নিজের মধ্যে ধারণ করেন বলেই বুঝি শিশুদের সাথে তাঁর সখ্যতা।
কচি-কাঁচার মেলা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ শিশু-কিশোর সংগঠন। দীর্ঘ ষাট বছর যাবৎ সংগঠনটি সারাদেশের শিশু-কিশোরদের শরীর ও মনন বিকাশে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। মেলার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শিশু-সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিশু-সংগঠনটির কর্মকা-ে আগ্রহ দেখিয়েছেন মেলার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। মূলতঃ পরামর্শ ও উপদেশনার ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। মেলার অনুষ্ঠানসমূহে যোগদান করে তিনি শিশুদের উৎসাহিত করতেন। এখনো ব্যস্ততার মাঝে শিশুদের ডাকে যথাসম্ভব সাড়া দিয়ে থাকেন।

বিভিন্ন সুধি সমাবেশে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অনেক কঠিন কঠিন বিষয়ে মননশীল বক্তব্য রাখেন। কিন্তু কচি-কাঁচার মেলার শিশু সমাবেশে তিনি একজন প্রবীণ শিশুর মতই বক্তব্য রাখেন। শিশুরা গভীর আগ্রহে তাঁর কথা শোনে এবং উৎসাহিত হয়। মেলার অনেক অনুষ্ঠানে তিনি এসেছেন। কিছু স্মৃতি চয়ন করছি।

অনেক বছর আগের কথা। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা ঢাকায় শিশুদের বিতর্ক প্রশিক্ষণ শেষে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। বিতর্ক কর্মশালায় শিশুদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন মেহের নিগার। প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর অংশ হিসাবে আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অনেক শিশু-কিশোর অংশ নিয়েছিল। বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণের জন্য অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসাবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমন্ত্রণ জানান হল। তিনি সম্মত হলেন। সময়মতই তিনি উপস্থিত হলেন। অনুষ্ঠান শুরুর আগে প্রথম স্থান অধিকারী ক্ষুদে বিতার্কিককে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম সামনে। বয়স বড়জোর নয় বা দশ বছর। শিশুটিকে প্রধান অতিথির সামনে এনে বললাম, ‘এ শিশুটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে’। প্রধান অতিথি স¯েœহে শিশুটির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরীক্ষায়, খেলাধুলায় প্রথম স্থান পায়। তুমি পেয়েছো বিতর্কে। বিতর্ক আবার কি জিনিষ’! সপ্রতিভ শিশুটি বলে উঠলেন, ‘তুমি তো টিচার, তুমি বিতর্ক মানে জানো না? বিতর্ক মানে ঝগড়া না করে যুক্তি দিয়ে কথা বলা।’ পুরস্কার বিতরণের পর প্রধান অতিথির ভাষণে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিশুটির চিন্তার প্রসারণ ঘটিয়ে বলেছিলেন যে, ঝগড়া করলে মাথায় রাগ চড়ে যায়, বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। ক্ষতিই হয়, লাভ হয় না কোন। ঝগড়ার বিষয়টি যদি আমরা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করি, যুক্তি দিয়ে বলি তাহলে একটা সমাধানে পৌঁছানো যায়। রাগের মাথায় সম্পর্ক নষ্ট করতে হয় না। বিতর্ক একটি সুস্থ বিষয় আর ঝগড়া হলো অসুস্থ প্রক্রিয়া। বিতর্ক বন্ধুত্ব সুষ্টি করে, আর ঝগড়া বন্ধুত্ব নষ্ট করে। বিতর্কের মাধ্যমে আমরা শিক্ষা অর্জন করি আর ঝগড়ার মাধ্যমে আমরা সুচিন্তা বর্জন করি। কোনটা ভালো, বিতর্ক না ঝগড়া? ক্ষুদে বিতার্কিকেরা সমস্বরে জবাব দিল ‘বির্তক’।

কচি-কাঁচার মেলার ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর বিকেলে সারাদেশ থেকে আগত শত শত নবীন-প্রবীণ সদস্যদের আনন্দমুখর অনুষ্ঠানে তিনি মনখুলে কথা বলেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। সভার প্রতিবেদনে তাঁর বক্তৃতার সারকথাটুকু রেকর্ড করা হয়েছে। সেটুকুই এখানে উল্লেখ করছি। শিশু-সংগঠনের দর্শনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়ক নয়। প্রতিভা বিকাশের সেই কাজটি করে যাচ্ছে কচি-কাঁচার মেলা। লেখাপড়ার সাথে সাথে খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক চর্চ্চা করলে শিশু-কিশোরদের মনের বিকাশ ঘটবে। তারা জঙ্গী হবে না। সাম্প্রদায়িক হবে না। এটা শুধু আমার আশাবাদ নয়, আমার গভীর বিশ্বাস”। তাঁর এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে কচি-কাঁচার মেলার সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততা ও অভিজ্ঞতা। মেলার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই বক্তৃতা প্রদানকালে প্রায়ই উচ্চারণ করতেন, “কচি-কাঁচার মেলার সদস্যরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিন্তু কেউই রাজাকার হয়নি।” সাংস্কৃতিক চর্চ্চা যে মানুষকে পরীশীলিত করে সে কথার প্রতিধ্বনি করেছেন ড. আনিসুজ্জামান।

ষাটের দশকে ‘কচি-কাঁচা’ নামে একটি শিশু সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতো কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা। এটি বেশ উন্নতমানের শিশু-কিশোর পত্রিকা ছিল। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লেখা ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতেন। পত্রিকাটির বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এই সেদিনও পত্রিকাটির একটি পুরানো সংখ্যা হাতে নিয়ে এটি পূন:প্রকাশের কথা বলছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নির্ভর প্রগতিশীল আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। সেই স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াচ্ছেন তিনি সবখানে। সংঘাত-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানব-বন্ধন, মিছিল, আলোচনা চক্র, ঘৃণা জ্ঞাপন সবখানে আছেন আনিসুজ্জামান। সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক তথা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে। সেখানে মধ্যমণি আনিসুজ্জামান। কবিতা পাঠ, সাহিত্য সভা, পুস্তক প্রকাশ, নাটক মঞ্চায়ন- কেন্দ্রবিন্দুতে আনিসুজ্জামান। দুর্বলের বঞ্চনা, সংখ্যালঘুর লাঞ্ছনা, নারীর অবমাননা তথা মানবতার ওপর আঘাত- সেখানে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আনিসুজ্জামান। পহেলা বৈশাখের আনন্দানুষ্ঠান, ষোলই ডিসেম্বরের বিজয়উল্লাস, ভাইফোঁটা, নবান্ন, পিঠাউৎসব তথা লোক-সংস্কৃতির গর্বিত অনুষ্ঠান। মধ্যমণি আনিসুজ্জামান। বয়সে প্রবীণতমদের অন্যতম হলেও বয়সের ভারে নুব্জ হননি। তারুণ্যের দীপ্তি নিয়ে আশার মশাল হাতে নিয়ে সমাজের সর্বঅঙ্গণ আলোকিত করছেন। হতাশার কুয়াশা কাটিয়ে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলছেন। সমাজ জাগরণ প্রয়াসে তিনি চিরতরুণ। দীর্ঘজীবী হোন আলোর দিশারী আনিসুজ্জামান।  

  




Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে