Header Ads Widget

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

সুফিয়া কামালকে জন্মবার্ষিকী শ্রদ্ধার্ঘ্য


                                                  ডঃ আনিসুজ্জামন


এবারে ২০ জুন বেগম সুফিয়া কামালের বয়স ৮৫ পূর্ণ হলো। বাংলা তারিখ হিসেব করলে তার জন্মদিন ১০ আষাঢ়। পঞ্জিকার পাতায় বঙ্গীয় আর খ্রিষ্টীয় তারিখ দু’টি মিলবে না। ১৩১৮ সালের রবিবার ১০ আষাঢ় ছিল। ১৯১১ সালের ২৫ জুন। আর ১৯১১ সালের ২০ জুন ছিল মঙ্গলবার, ৫ আষাঢ় ১৩১৮। আমরা যে কোনো একটি তারিখ ধরে তাঁর জন্মদিন পালন করতে পারি। তবে সেকালের কথা মনে রাখলে বাংলা তারিখই  প্রামাণ্য মনে হয়।

সুফিয়া কামাল যে ৮৫ বছর পূর্ণ করবেন, এ সৌভাগ্য যতটা তাঁর চেয়ে বেশী আমাদের। আমাদের সমাজে অনুকরণীয় মানুষের বড় অভাব। তাঁকে দেখিয়ে আমরা অন্যদের বলতে পারি। এঁকে অনুকরণ করো। মহৎ মানুষ, আদর্শনিষ্ঠ মানুষ, বিবেকবান মানুষ, সৎ মানুষের উদাহরণ দিতে গেলে তাঁর কথা বলতে পারি। আমাদের মধ্যে তিনি থাকলে আমরা সাহস পাই, প্রেরণা লাভ করি। আমাদের মুরুব্বি নেই, তিনি এই জাতির অভিভাবক স্বরূপ।

কোন গুণে এত বড় একটা আসন তিনি লাভ করলেন? কেবল কবি হিসেবে নয়, শুধু নারী সমাজের নেত্রী হিসেবে নয়, বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে নয়। তাঁর সকল কর্ম, সকল রচনা, সকল ভাবনার সমন্বয়ে-আর সব কিছুর মুলে তাঁর চরিত্রগুণে- তিনি এই আসনটি পেয়েছেন। তাঁর কোমল মাতৃহৃদয় থেকে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা যেমন স্বত্যোৎসারিত, তেমনি বুকভরা সাহস নিয়ে জাতির প্রয়োজনে ভগ্নস্বাস্থ্য এই মানুষটি অকুতোভয়ে এসে দাঁড়ায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখে, বিপদে আপদে তিনি আমাদের তেমনি করে আগলে রেখেছেন।

সুফিয়া কামালের দীর্ঘ জীবন-গভীর সংগ্রামের জীবন। যখন তিনি নিতান্ত শিশু, একেবারেই মাতৃক্রোড়ে, তখন পিতা হয়ে গেলেন নিরুদ্দেশ। এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে মা এলেন পিত্রালয়। মাতুলালয় শায়েস্তাবাদের নবাববাড়ীর  কঠোর শাসনের মধ্যে বড় হয়েছেন সুফিয়া কামাল। সে শাসন ছিল নারী শিক্ষা রিরোধী, যদিওবা  আরবি ফারসি পড়ার হুকুম ছিল, বাড়িতে কথা বলা হতো উর্দুতে এবং বাংলার স্থান ছিল না সেখানে। তবু ভাইদের সঙ্গে ছেলে সেজে সুফিয়া স্কুলে গেছেন, এবং বাংলা শিখেছেন, সাহিত্যপত্র পাঠ করেছেন, সাহিত্যসৃষ্টির বাসনা পোষণ করেছেন। বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় ষোল বছর বয়সী মামাতো ভাই  সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে। স্বামীর উৎসাহে বরিশালের একটি পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর একটি ছোট গল্প। অবশ্য তার জন্যে অভিভাবকদের গঞ্জনা শুনতে হয় উভয়কেই। ১৯২৬ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় এলে তাঁর এক আত্মীয় কবিকে দেখান কাঁচা হাতের লেখা সুফিয়া এন হোসের কবিতা, নজরুল সুফিয়াকে লেখেন ‘সওগাত’-এ কবিতা পাঠাতে। সুফিয়া কবিতা পাঠালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন তাঁর মধ্যে আবিস্কার করেন যর্থাথ কবি প্রতিভা। শুধু কবিতা ছাপেন, তা নয়, মহিলা সংখ্যা ‘সওগাত’-এ ছেপে দেন তাঁর ছবিও এবং তাও হয়ে ওঠে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা।  নেহাল হোসেনের উৎসাহে উড়োজাহাজে চড়ে পরিক্রমণ করেন কলকাতার আকাশে এবং তাও বিবেচিত হয় কুলের লজ্জা হিসেবে। তারপর ১৯৩২ সালে অকস্মাৎ স্বামীর মৃত্যু এবং শিশু কন্যা নিয়ে জীবন সংগ্রামে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাঁর ছিল না, তিনি ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের স্কুলের শিক্ষকতার কাজ। নিজেকে তৈরী করে নিলেন এই দায়িত্বের জন্যে। প্রায় দশ বছর সে দায়িত্ব পালন করেন তিনি আর পাশাপাশি অবিচল থাকেন সাহিত্য সাধনায় এবং সামান্য বেতনে সংসার চালনায়। বেনজীর আহমদের উদযোগে ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গল্পগুচ্ছ ‘কেয়ার কাঁটা’ এবং পরের বছরে কাব্যগ্রন্থ ‘সাঝের মায়া’। কাব্যগ্রন্থ সর্ম্পকে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন ‘তোমার কবিত্য আমাকে বিস্মিত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্চে এবং ধ্র“ব তোমার প্রতিষ্ঠা’। কবির আশা সত্য হয়েছিল।

১৯৩৯ সালে উদারহৃদয় সাহিত্য প্রেমিক সরকারি কর্মকর্তা কামালউদ্দিন খানের (তিনি নিজেও বই লিখেছিলেন) সংগে তাঁর পুনবিবাহ হয় মিজানুর রহমানের বদৌলতে। শুরু হয় তার নতুন জীবন, ফিরে পান স্বস্তি, সংসার পূর্ণ হয় পুত্র কন্যাদের আর্বিভাবে। প্রতিষ্ঠিত হন কবি রূপে এবং সেই সংগে শুরু করেন সমাজকর্ম, জনসেবা তাতেও উৎসাহ জুগিয়েছিলেন কামালউদ্দিন খান। প্রকৃত পক্ষে সুফিয়া কামালের সমাজ সেবার সূচনা হয়েছিল বরিশালে। মা ও শিশুদের কল্যাণ চেষ্টায়, ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে পার্ক সার্কাস অঞ্চলে উদ্বা¯তু নারীদের দেখাশোনা এবং উদ্বা¯তু শিশুদের লেখাপড়া করানোর  কাজে আত্মনিয়োগ করেন সুফিয়া কামাল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁদের পরিবার পাকাপাকিভাবে চলে আসেন ঢাকায় এবং ১৯৪৮ সালে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি গঠনে। ১৯৫০-এ দাঙ্গার সময়ে তিনি কাজ করেন শান্তি কমিটির হয়ে, এবং ১৯৫১-এ গড়ে তোলেন শিশু রক্ষা সমিতি। ১৯৫৬ সালে তাঁরই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় কচি-কাঁচার মেলা। ১৯৬২ সালে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনে তিনি পালন করেন বিশিষ্ট ভূমিকা। ১৯৬৫ সালে গড়ে তোলেন নারী কল্যাণ সমিতি, ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ। পাকিস্তান সোভিয়েত (পরবর্তী কালে বাংলাদেশ সোভিয়েত) মৈত্রী সমিতি, রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সংগেও তাঁর সর্ম্পক গভীর।

বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সুফিয়া কামাল আমাদের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিধ্বংসী সব রকম ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করে এসেছেন। প্রাদেশিক গর্ভণর মোনায়েম খানের আশ্রয়পুষ্ট মাস্তানেরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ড. আবু মাহমুদকে প্রহার করে এবং এই নিয়ে বড় রকম প্রতিবাদ দেখা দেয় দেশে, তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সংগে দেখা করে যে প্রতিনিধি দল প্রাদেশিক সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিল, তিনি ছিলেন তার সদস্য। আইয়ুবের ব্যঙ্গোক্তির জবাব তিনি দিয়েছিলেন মুখের উপরে উর্দ্দু ভাষায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর দুইমেয়ে লুলু ও টুলু ভারতে গেলে তাঁর চিন্তার অন্ত ছিলনা, তবুও মনকে বুঝিয়ে ছিলেন এই বলে যে, তারা দেশের জন্যে কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের কালে তাঁর বড়মেয়ে দুলুর স্বামী আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। এই কষ্ট তিনি সহ্য করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় নানাভাবে সাহায্য করেছেন যুদ্ধ প্রচেষ্টায়। বিজয় লাভের পরে বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত, শহীদ পরিবারের কল্যাণ এবং জাতীয় পুর্নগঠনের জন্যে তিনি যথাসাধ্য করেছেন।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। অসুস্থ শরীরেও তিনি মিছিলে যোগ দিয়েছেন এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার  জন্যে পুলিশের উদ্যত লাঠির সামনে স্থান ছেড়ে যাননি। অন্যদিকে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইনে যে সংস্কার আইয়ুব খান করেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। বাংলাদেশে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের জন্যে যে আন্দোলন দেখা যাচ্ছে, তার পশ্চাতেও রয়েছে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। তিনি নারী পুরুষের এবং সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমানাধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। সম্প্রদায়িকতার রিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকাও অবিস্মরণীয়।

আমার সৌভাগ্য, শৈশব থেকে তাাঁর সাহচার্য পেয়েছি, তাঁর কোলেপিঠে চড়েছি এককালে।  আমার আব্বাকে তিনি ভাই বলতেন, তিনি তাই আমাদের ভাইবোনদের ফুপু। আমার পিএইচডি ডিগ্রী লাভের পর থেকে কামাল ফুপা আমাকে ডাকতেন ডাক্তারের বেটা ডাক্তার বলে আর ফুপু মৃদু মৃদু হাসতেন। তাঁর ভালবাসার অমৃত ধারায় এখনো যে সিঞ্চিত হবার সুযোগ পাই, এতো খুব বড় পাওয়া। তাঁর আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে যা লিখেছিলাম, তার থেকে পুনরাবৃত্তি করে আজ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।

সমাজের জমাট অন্ধকারের মধ্যে অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল ধরে প্রত্যয়, প্রগতি ও সাহসিকতার দীপশিখা নিয়ে পথ চলছেন বেগম সুফিয়া কামাল। কখনো মনে হয়েছে তাঁর অভিযান বুঝি একজন ব্যক্তির কিংবা একান্তই নারীর অথবা তাঁর সম্প্রদায়ের। আসলে তা সমষ্টির, তা দেশকালাশ্রয়ী। মাতৃস্বরূপা তিনি, তিনি প্রেমময়ী, কল্যাণী, অভয়দাত্রী। তিনি চিরকাল আমাদের মধ্যে থাকবেন।

Post a Comment

0 Comments

যে দোয়া পড়া সুন্নত কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে